তাবলিগের কেন্দ্রীয় মারকাজ দিল্লি নিজামুদ্দিনের প্রধান মুরুব্বি মাওলানা সাদ গতকাল বাদ মাগরিব আলেমদের উদ্দেশ্যে দাওয়াতি কাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে এক বিশেষ বয়ান পেশ করেন। আলেমদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘দাওয়াতের মাধ্যমেই ইসলাম প্রচার এবং প্রসার হয়েছে।
বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের উদ্দেশ্য হলো- ইসলামের দাওয়াত বিশ্বব্যাপী চালু করা। আর যারা ইজতেমায় আসবেন তাদের প্রত্যেকের অন্তরে এ সংকল্প থাকবে যে, মৃত্যু পর্যন্ত দাওয়াতে দ্বীনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখা।
দাওয়াতে দ্বীনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখা হলো নবি ও সাহাবাদের কাজ। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন, ‘(হে রাসুল!) বলুন, এটাই আমার পথ। আমি আল্লাহর পথে বুঝে দাওয়াত প্রদান করি; আমি এবং আমার অনুসারীরা।
দুনিয়াতে আল্লাহ তাআলা যত নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন, সবাই মানুষকে এক আল্লাহর পথে দাওয়াত দিয়েছেন। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি আপনার পূর্বে প্রত্যেক রাসূলের নিকট এই মর্মে প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছি যে, আমি ব্যতীত ইবাদতের উপযুক্ত কেউ নেই। সুতরাং তোমরা আমার ইবাদত করো।’
পয়গাম্বরগণ কালিমার জিকিরের চেয়ে দাওয়াতই বেশি দিতেন। কালিমার জিকিরের সময় অন্তরে অন্যকিছুর চিন্তা-ভাবনা আসা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু দাওয়াতের সময় গায়রুল্লাহ তথা অন্যের ইবাদত-বন্দেগির চিন্তা মনে আসে না। এ কারণেই কালিমার দাওয়াতের কাজই বেশি বেশি করতে হবে।
আল্লাহর রাসুলের সাহাবাগণ দাওয়াতে দ্বীনের কাজে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তাদের কালিমার এ দাওয়াতের কারণেই আজ পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দ্বীন ও ইসলাম তরবারির জোরে প্রতিষ্ঠিত হয়নি বরং সাহাবায়ে কেরামের দাওয়াত এবং উন্নত চরিত্রের মাধ্যমেই ইসলাম প্রচারিত ও প্রসারিত হয়েছে। মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে দাওয়াত প্রদান করাই ছিল সাহাবায়ে কেরামের দাওয়াতের একমাত্র পদ্ধতি।
প্রিয়নবি সাহাবাদের দাওয়াতের পদ্ধতি সময়ের পরিবতর্নে কোনো ধরনের পরিবর্তন সাধিত হবে না। যেমনি ভাবে সময়ের পরিবর্তনে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মিসওয়াক করার পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। সুতরাং প্রিয়নবি এবং সাহাবায়ে কেরামগণ যেভাবে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন, ঠিক সেভাবেই উম্মাহর মাঝে ইসলামের দাওয়াত দিতে হবে।
আল্লাহর রাসুলের সাহাবাগণ নিজেদের জীবন, সম্পদ এবং গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করে ইসলামের দাওয়াতের কাজ করে গেছেন। আর ভালোবাসা তৈরি হয় সেই কাজের সঙ্গে যে কাজে মানুষের জীবন, সম্পদ ও সময় ব্যয় হয়। এ কারণেই সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে দাওয়াতে দ্বীনের ভালোবাসা সবচেয়ে বেশি তৈরি হয়েছিল। তারা ছিলেন দ্বীন ও ইসলামের সহযোগিতাকারী। ফলে দ্বীনের সহযোগিতার ফলে আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য সব সাহায্যের দরজা খুলে দিয়েছেন।
কোনো ব্যক্তি দ্বীনদার হওয়া আর দ্বীনের সাহায্যকারী হওয়া এক জিনিস নয়। বরং দ্বীনের সাহায্যকারী হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বান্দার সঙ্গে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছেন। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন, ‘তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য করো, তাহলে তিনিও তোমাদের সাহায্য করবেন।’ আর এখানে আল্লাহ তাআলাকে সাহায্য করার মর্মার্থই হলো দ্বীন ও ইসলামের সাহায্য করা।
মানুষের অত্যন্ত প্রশংসনীয় গুণ হলো ধৈর্যশীল ও সহনশীলতা প্রদর্শন করা। আল্লাহ তাআলা মানুষকে কষ্ট স্বীকারে ধৈর্যধারণ এবং শহনশীলতা অবলম্বন করার ক্ষমা দান করেছেন। এ কারণেই দ্বীনের জন্য কষ্ট স্বীকার করার পাশাপাশি দ্বীন ও ইসলাম প্রতিষ্ঠায় দ্বীনের ওপর অবিচল থাকার গুণ আল্লাহ তাআলা মানুষকে দান করেছেন।
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবাগণ ছিলেন দ্বীন প্রতিষ্ঠার এবং দ্বীনের ওপর অবিচল থাকার মূর্তপ্রতীক। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে হুজায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বন্দি হয়ে রোম সম্রাটের নিকট আসলে সম্রাট তাকে ইসলাম ত্যাগ করার প্রস্তাব দেয়। বিনিময়ে তার রাজত্বের অর্ধেক লিখে দেয়ার কথা বলে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে হুজায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহু রোম সম্রাটের এ প্রস্তাবকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃপর সম্রাট তাকে লোমহর্ষক নির্যাতনের ভয় দেখায়। কিন্তু আবদুল্লাহ ইবনে হুজায়ফা দ্বীনের ওপর এতটাই অটল ও অবিচল ছিল যে, চোখের সামনে কড়াইয়ে তৈল গরম করা হলো। ফুটন্ত তেলে খানিকবাদেই কৈ ভাজা হতে যাওয়া আবদুল্লাহর চোখে মুখে হতাশার লেশমাত্র নেই।
সম্রাট তাঁকে ডাকলেন। হজরত আবদুল্লাহ পাহাড়সম দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে গেলেন। সম্রাট তাঁকে বললেন, ‘দ্বীন ত্যাগ করলে মুক্তি মিলবে, নতুবা এখনই নিশ্চিত মৃত্যুর সঙ্গে আলিঙ্গন করতে হবে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে হুজায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহু অশ্রুসিক্ত নয়নে আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘হায়! আমার যদি একশ’টি প্রাণ থাকতো তাহলে প্রতিটি প্রাণ আল্লাহর জন্য এভাবে উৎসর্গ করতাম।
হজরত আবদুল্লাহর কথা শুনে ভরকে গেলো রোম সম্রাট। কী বলে এ মুসলমান! এরা কোনো ভিন্ন জগতের প্রাণি নয় তো? হজরত আবদুল্লাহ ইবনে হুজায়ফাসহ আটক সব সাহাবাকে তাড়াতাড়ি মুক্তি দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সম্রাট। আর এভাবেই আল্লাহর সাহায্য ধরা দিয়েছিল সাহাবায়ে কেরামের জীবনে।
আল্লাহ তাআলার গায়েবি সাহায্য ইনফেরাদি দাওয়াতের ওপর নির্ভর। আর গায়েবি সাহায্য বলতে আমরা বুঝি, বাহ্যিক উপায়-উপকরণ ব্যতিরেখে প্রয়োজন পূরণ হয়ে যাওয়া। বিষয়টি আসলে তা নয়। মূলতঃ গায়েবি সাহায্য হচ্ছে- অমুসলিমদের মাঝে দ্বীনের দাওয়াত এমনভাবে পৌছানো যাতে সে মুসলমান হতে তথা দ্বীন ও ইসলাম গ্রহণে বাধ্য হয়।
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো এক সফরে ছিলেন। সঙ্গে সাহাবাগণও ছিলেন। পথিমধ্যে এক গ্রাম্য লোকের সঙ্গে দেখা হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে আল্লাহর দ্বীনের দিকে দাওয়াত দিলেন।
সে ব্যক্তি বলল, আপনি যে আল্লাহর রাসুল, তার সাক্ষি (প্রমাণ) কি? প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবাদের সাক্ষি করেননি। বরং একটি গাছকে ডাকলেন। গাছটি মাটি চিঁড়ে এসে প্রিয়নবির নবুয়তের সত্যতার সাক্ষ্য দিয়ে চলে যায়। যা দেখে ওই গ্রাম্য লোক ইসলাম গ্রহণ করে। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে এভাবেই গায়েবি সাহায্য এসেছিল।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দূত মারফত বিভিন্ন রাজা-বাদশাহদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পাঠিয়েছেন। এতে বুঝা যায় যে, দাওয়াতের জন্য কোনো ব্যক্তির যাওয়া জরুরি। পারস্যের দাম্ভিক সম্রাট যখন প্রিয়নবি ইসলামের দাওয়াতের পত্র ছিঁড়ে ফেলে তখন এ সংবাদ শুনে প্রিয়নবি বললেন, সে আমার পত্র নয় বরং তার সাম্রাজ্যকে টুকরো টুকরো করে ফেললো। পরবর্তীতে পারস্যের দাম্ভিক সম্রাটের পতন হয়েছে এবং পারস্য সাম্রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এটাও আল্লাহ তাআলার গায়েবি সাহায্য।
তাই আল্লাহ তাআলার গায়েবি সাহায্য সহযোগিতা পেতে চাইলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের তরিকায় দাওয়াতে দ্বীনের কাজ করতে হবে। প্রিয়ননি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, ‘আমার একটি কথা হলেও তা অন্যের কাছে পৌঁছিয়ে দাও।’ সাহাবায়ে কেরাম ওই ময়দান থেকেই দাওয়াতে দ্বীনের কাজে বেরিয়ে পড়িছিলেন।
নবি ও সাহাবাদের দাওয়াতি কাজে আমাদেরকেও টঙ্গীর ময়দান থেকে ইসলামের দাওয়াতের মিশন নিয়ে বিশ্বব্যাপী বের হতে হবে। কেননা আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এ কাজের জন্যই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা হলে শ্রেষ্ঠ জাতি। মানুষের কল্যাণেই তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে বারণ করবে আর আল্লাহর প্রতি অবিচল ঈমান রাখবে।’
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা দাওয়াতের কথা আগে এবং ঈমানের কথা পরে উল্লেখ করেছেন। কারণ ঈমান পূর্ণতা লাভ করবে দাওয়াতে দ্বীনের মাধ্যমেই। আর দ্বীন ও ইসলামের দাওয়াত হলো আল্লাহ প্রদত্ত মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব ও কর্তব্য।