এক মাদরাসা ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে দিনব্যাপী তাণ্ডব চালায় কয়েকশ বিক্ষুব্ধ মাদরাসা ছাত্র। সেদিনের সেই তাণ্ডবলীলায় অন্তত একশ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়।
যদিও তুচ্ছ একটি ঘটনা নিয়ে ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় এ তাণ্ডবের সূত্রপাত। তাণ্ডবের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন, উপমহাসদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ উস্তাদ আলউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গণ ও শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরের কয়েটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়।
এসব ঘটনায় মোট ১৩টি মামলায় প্রায় ১৩ হাজার মানুষকে আসামি করা হয়। তবে তাণ্ডবের এক বছরেও গ্রেফতার হয়নি প্রকৃত হামলাকারীরা।
যদিও পুলিশ বলছে, হামলার সময় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজে দেখে তাণ্ডবের সঙ্গে জড়িত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসামি গ্রেফতার করা হয়েছে। অচিরেই আদালতে মামলাগুলোর অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা হবে।
ঘটনা-১
১১ জানুয়ারি বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরশহরের জেলা পরিষদ মার্কেটের সামনে অটোরিকশার ভাড়া নিয়ে অটোচালকের সঙ্গে স্থানীয় জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসার এক ছাত্রের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে জেলা পরিষদ মার্কেটের বিজয় টেলিকমের স্বত্তাধিকারী জয় ওই মাদরাসা ছাত্রকে এসে থাপ্পড় দেন।
এ নিয়ে সন্ধ্যায় অর্ধশত ছাত্র বিজয় টেলিকমে গিয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। পরে পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে মাদরাসা ছাত্রদের শান্ত করতে চাইলে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এক পর্যায়ে তা রূপ নেয় সংঘর্ষে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও মাদরাসা ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
ত্রিমুখী এ সংঘর্ষ চলাকালে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ২০-২৫টি ককেটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ কয়েক রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছোড়ে। কয়েক দফা চলা ওই সংঘর্ষে তিন পুলিশসহ অন্তত ২০ জন আহত হন।
ঘটনা-২
মাদরাসা ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনায় ১২ জানুয়ারি ভোরে জেলা সদর হাসপাতালে হাফেজ মাসুদুর রহমান (১৮) নামে আহত এক মাদরাসা ছাত্রের মৃত্যু হয়। মাসুদের সহপাঠীরা অভিযোগ করেন, সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে মাসুদের মৃত্যু হয়। মূলত মাসুদের মত্যুর পরই মাদরাসা ছাত্রদের বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর।
১২ জানুয়ারি সকাল থেকে বিক্ষুব্ধরা শহরের হাসপাতাল রোড, লোকনাথ ময়দান ও টি.এ রোডে টায়ার জ্বালিয়ে ও বাঁশ ফেলে সড়ক অবরোধ করে। এরপর মাদরাসা ছাত্রদের একটি বিক্ষোভ মিছিল থেকে স্থানীয় ব্যাংক এশিয়ার কার্যালয়ের গ্লাস ভাঙচুর এবং সদর-৩ আসনের সংসদ সদস্য র.আ.ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর ছবি সম্বলিত বেশ কিছু ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা হয়।
ঘটনা-৩
মাদরাসা ছাত্র মাসুদের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১২ জানুয়রি সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনে দু’দফা হামলা চালিয়ে ভঙচুর এবং রেললাইনে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ মাদরাসা ছাত্ররা।
তৎকালিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার এস.এম মহিদুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে একদল মাদরাসা ছাত্র অতর্কিতভাবে রেলওয়ে স্টেশনে এসে হামলা চালায়। এসময় তারা স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফরমের দরজা-জানালা, স্টেশন মাস্টারের কক্ষ, প্যানেল বোর্ড, টেলিফোন ও চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করে।
এছাড়া বিক্ষুব্ধরা স্টেশন সংলগ্ন রেলক্রসিংয়ে গাছের গুঁড়ি ফেলে ও টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে অবরোধ করে রাখে। এতে করে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
ঘটনা-৪
১২ জানুয়ারি দুপুরে শহরের হালদারপাড়াস্থ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়েও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন বিক্ষুব্ধ মাদরাসা ছাত্ররা। এ সময় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের পাশের একটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন বিক্ষুব্দরা। এরপর হামলাকারীরা উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গণে হামলা চালিয়ে সঙ্গীতাঙ্গণের চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করেন এবং সঙ্গীতাঙ্গণের জাদুঘরে সংরক্ষিত উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহদ সরোদ ও জায়নামাজসহ অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র ভেঙে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। একই সময় শহরের ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ভাষা চত্বরের বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়েও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধরা।
১২ জানুয়ারি বিকেলে কে বা কারা গুজব ছড়িয়ে দেয় যে হাসপাতাল থেকে নিহত মাদরাসা ছাত্রের মরদেহ দেয়া হচ্ছে না। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ মাদরাসা ছাত্ররা শহরের টি.এ রোডস্থ ফকিরাপুলে দাঁড়ানো অবস্থায় পুলিশ সদস্যদের বহনকারী একটি পিকআপ ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দেয়। একই সময় জেলা সদর হাসপাতালে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধরা।
তাণ্ডবের পরেও হাফেজ মাসুদুর রহমানের মৃত্যুর প্রতিবাদে ও সদর মডেল থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তার প্রত্যাহারের দাবিতে হরতাল ডাকে কওমি ইসলামী ছাত্র ঐক্য পরিষদ।
বিক্ষুব্ধ মাদরাসা ছাত্রদের নিবৃত করতে সন্ধ্যায় জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসায় বৈঠকে বসে জেলা প্রশাসন। মাদরাসার বৈঠকখানায় প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চলা ওই বৈঠক শেষে সদর মডেল থানার সহাকারী পুলিশ সুপার (এসএসপি) তাপস রঞ্জন ঘোষ ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আকুল চন্দ্র বিশ্বাসকেপ্রত্যাহার এবং নিহত ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাস পেয়ে হরতাল প্রত্যাহার করে নেয়বিক্ষুব্ধরা। এর ফলে থম-থমে থেকে স্বাভাবিক হতে শুরু করে শহরের পরিস্থিতি।
এদিকে, মাদরাসা ছাত্রদের চালানো তাণ্ডবের ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত পুলিশ প্রকৃত হামলাকারীদের গ্রেফতার করতে পারেনি বলে অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। পাশাপাশি আদালতে কোনো মামলারই অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মঈনুর রহমান জানান, মামলাগুলো স্পর্শকাতর হওয়ায় কিছুটা সময় নিয়ে তদন্ত কাজ চলছে। তবে মামলাগুলোর অগ্রগতিও রয়েছে। প্রতিটি মামলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসামি গ্রেফতার হয়েছে। অচিরেই আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা হবে।