নাসিরনগর হামলা : পরিকল্পনাকারীদের বিচার চান ক্ষতিগ্রস্তরা

নাসিরনগর হামলা : পরিকল্পনাকারীদের বিচার চান ক্ষতিগ্রস্তরা

বছরজুড়ে যে কয়েকটি ঘটনা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে আলোচনায় এনেছে তার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার হিন্দুপল্লীতে হামলার ঘটনাটি ছিল অন্যতম। দুষ্কৃতকারীরা উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত কয়েকটি এলাকায় হামলা চালিয়ে শতাধিক ঘর-বাড়ি ও ১০টি মন্দির ভাঙচুর, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করে।

হামলার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ক্ষতিগ্রস্তদের দাবির প্রেক্ষিতে নাসিরনগর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাদেরকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এছাড়া প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) চৌধুরী মোয়াজ্জেম আহমদকেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়য়ে ন্যস্ত করা হয়।

এ হামলার ঘটনায় নাসিরনগরে যুগ যুগ ধরে চলে আসা হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে যেমন ‘ক্ষত’ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। যদিও প্রশাসনের প্রাণপণ চেষ্টায় নসিরনগরের হিন্দু-মুসলমানসহ অন্যান্য ধর্মালম্বীদের মধ্যে থাকা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ‘ক্ষত’ অনেকটাই শুকিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের ২৯ অক্টোবর ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর ছবি পোস্ট দেয়ার অভিযোগে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) মামলায় গ্রেফতার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ (৩০) দাসের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে নাসিরনগর উপজেলা।

পরদিন (৩০ অক্টোবর) মাইকিং করে সমাবেশ ডাকে দুটি ইসলামী সংগঠন। সমাবেশ শেষ হওয়ার পরপরই দুষ্কৃতকারীরা নাসিরনগর উপজেলা সদরের হিন্দু অধ্যুষিত কয়েকটি এলাকায় হামলা চালায়।দুষ্কৃতকারীরা অন্তত ১০টি মন্দির ও শতাধিক ঘর-বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করে।

এরপর ৪ নভেম্বর ভোরে ও ১৩ নভেম্বর ভোরে দুস্কৃতিকারীরা আবারও উপজেলা সদরে হিন্দু সম্প্রদায়েরর অন্তত ৬টি ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এসব ঘটনায় নাসিরনগর থানায় পৃথক ৮টি মামলা দায়ের করা হয়। মামলাগুলোতে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাসহ ১০৫ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর সেই ছবির ‘সন্দেহভাজন’ পোস্টকারী ও আলোচিত আল-আমিন সাইবার ক্যাফের সত্ত্বাধিকারী জাহাঙ্গীর আলমের পর গত ২৭ ডিসেম্বর নিজ বাড়ি থেকে হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল আহাদকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

হামলার পর হিন্দু-মুসলমানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মাঝে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে জেলা পুলিশ উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন ওয়ার্ড ও গ্রামে সব ধর্মের মানুষদেরকে নিয়ে সম্প্রীতি সমাবেশ করে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মাঝে হামলার ঘটনায় গ্রেফতারের ভয় এড়াতে নিরপরাধ কাউকে গ্রেফতার করা হবে না জানিয়ে পুলিশ গ্রামে গ্রামে মাইকিংও করে।

এদিকে, হামলার দুই মাস পার হলেও মূল পরিকল্পনাকারীদের এখনো পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এ নিয়ে হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে কিছুটা অসন্তোষ থাকলেও তারা এখনো আশাবাদী মূল পরিকল্পনাকারী ও হামলায় জড়িতদের বিচার নিয়ে। তবে পুলিশ বলছে, ইতোমধ্যেই হামলার পরিকল্পনারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। খুব শিগগিরই তাদেরকে গ্রেফতার করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।

নাসিরনগর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘোষপাড়ার গৃহবধূ ধ্রুপতি ঘোষ জাগো নিউজকে বলেন, হামলার ঘটনায় আমরা মনে অনেক কষ্ট পেয়েছি। যুদ্ধের মতো করে ৪-৫শ’ লোক আমাদের বাড়িতে হামলা চালায়। এ ধরণের ঘটনা ঘটুক আমরা চাই না।হামলায় জড়িত সবার বিচার চাই আমরা।

ঘোষপাড়ার আরেক গৃহবধূ আরতি রাণী ঘোষ জাগো নিউজকে বলেন, আমরা নাসিরনগরবাসী এ ঘটানা আর দেখতে চাই না। আমরা হামলায় জড়িতদের বিচার চাই। সরকার হামলাকারীদের বিচার করবে বলে আমরা আশাবাদী।

হামলার শিকার গৌরমন্দিরের পুরোহিত নকুলানন্দ দাস অধিকারী জাগো নিউজকে বলেন, মন্দিরের ভাঙা অংশ সংস্কার করে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এ হামলার মূল পরিকল্পানাকারীদের এখনো আইনের আওতায় আনা হয়নি। আমরা চাই তাদেরকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হোক। হামলার সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িত সকলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলেই এ ধরণের ঘটনা আর ঘটবে না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাসিরনগর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবু জাফর জাগো নিউজকে জানান, সংখ্যালঘুদের শতভাগ নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করেছি। ইতিমধ্যেই হামলার ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। হামলার মূল পরিকল্পনাকারীদেরকেও চিহ্নিত করা হয়েছে, খুব দ্রুত তাদের গ্রেফতার করে করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।

জেলা সংবাদ