প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল বলেছেন, আমাদের একটু আন্তরিক সহানুভূতিপূর্ণ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি একজন প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে মানবমুক্তির অগ্রগতির প্রপঞ্চে। এটি সভ্যতার দায়িত্ববোধও বটে।
বুধবার জাতিসংঘে বাংলাদেশে স্থায়ী মিশনের প্রথম সচিব (প্রেস) মামুন-অর-রশিদের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্ব প্রতিবন্ধী সচেতনতা দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
সভায় জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেন, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে দায়িত্বপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসন করতে হবে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরে আমার অভিজ্ঞতা খুবই আনন্দদায়ক। দেশটি প্রতিবন্ধীদের বিকাশে বৈপ্লবিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা রাখেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. একে আব্দুল মোমেন। তিনি প্রতিবন্ধীদের বিকাশে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের বিস্তারিত কর্মসূচী তুলে ধরেন।
সূচনা পর্বে আরো বক্তৃতা করেন জাতিসংঘের ৬৬তম অধিবেশনের সাধারণ পরিষদের সভাপতি নাসির আব্দুল আজিজ আল নাসের, কাতারের স্থায়ী প্রতিনিধি শেখ মেশাল হামাদ, মিসেস সুজানি রাইট, বব রাইট ও সুসান ই রাইস।
প্যানেল ডিসকাশন পর্ব সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক সিএনএন প্রতিনিধি ক্রিস্টিয়ান আমানপুর। এতে অংশ নেন ড. মিস গিরালডিন দশন, মি. শেখর সাক্সেনা, সায়মা ওয়াজেদ হোসেইন, টনি ব্রাক্সটন, মাইকেল জন কেরলি প্রমুখ।
প্যানেল ডিসকাশনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় অটিজম কমিটির চেয়ারম্যান সায়মা ওয়াজেদ হোসেইন বলেন, ‘আপনারা জানেন, অটিজম হল একটি ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য সমস্যা। সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোলের (সিডিসি) তথ্য অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৮৮ জন শিশুর মধ্যে একজন অটিজমে আক্রান্ত। তবে এর মদ্যে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের আক্রান্তের হার অনেক বেশি। যেমন প্রতি ৫৪ জন ছেলের মধ্যে একজন এবং ২৫২ জন মেয়ের মধ্যে একজন অটিজমে আক্রান্ত যা সম্মিলিতভাবে ডায়াবেটিস, এইডস, ক্যান্সার, সেরিব্রাল পলসি, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের তুলনায় অনেক বেশি।’
তিনি বলেন, ‘গ্লোবাল অটিজম পাবলিক হেলথ (বাংলাদেশে যা গ্যাপ হিসেবে পরিচিত) বাংলাদেশে পুরানো বাধাগুলো অতিক্রম করে নতুনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এজন্য আপনাদের অকুণ্ঠ সমর্থনের জন্য আমি গ্যাপ বাংলাদেশের ন্যাশনাল অ্যাডভাইজারি কমিটির চেয়ার হিসেবে আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
বর্তমানে গ্যাপ বাংলাদেশ প্যারেন্টস এবং প্রফেশনালদের সমন্বয়ে অ্যাওয়ারনেস অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি, এডুকেশন, সার্ভিস এবং রিসার্চ এই চারটি টাস্কফোর্সের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। খুব শিগগিরই ইন্টারন্যাশনা টাস্কফোর্স এবং ইন্টার অর্গানাইজেশনাল ইমপ্লিমেন্টেশন টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত সংগঠনের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে গ্যাপ বাংলাদেশের কার্যক্রমকে আরো সম্প্রসারিত করা হবে।
পুতুল বলেন, ‘আজকে আমি আপনাদের অবহিত করতে চাই, গ্যাপ বাংলাদেশ ইতিমধ্যে কী কী কাজ করেছে। আমাদের টাস্কফোর্সের সদস্যদের স্বতঃপ্রণোদিত সহায়তা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের সিচ্যুয়েশন এনালাইসিস ডকুমেন্ট তৈরি করেছি। এই ডকুমেন্টে অটিজম এবং নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটিজ বিষয়ে আমাদের বর্তমানে সম্পদ কী আছে এবং কী কী প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা চিহ্নিত করেছি। এর সম্ভাব্য সমাধানের সুপারিশ করেছি। আমরা শিশুদের জন্য অটিজম স্পিকস থেকে প্রণীত কমিউনিটি টুলকিটের বাংলা অনুবাদ করেছি। এটি আমাদের প্যারেন্টস, টিচার এবং সার্ভিস প্রোভাইডার অর্থাৎ যারা এই জনগোষ্ঠীকে সেবা দিয়ে থাকেন তাদের জন্য একটি সহায়ক টুলস হিসেবে কাজ করবে।’
‘গত ২৫ জুলাই অটিজম বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন ১১টি দেশের অংশগ্রহণে সর্বসম্মতভাবে ঢাকা ঘোষণা করা হয় যা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জন্য একটি মাইল ফলক। এ সম্মেলনে শিশুদের মনঃস্বাস্থ্য সেবায় শুধু আঞ্চলিকভাবেই নয়, বিশ্ব জুড়ে আমাদের পারস্পারিক সহযোগিতা ও সমন্বিত প্রচেষ্টার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এসব শিশু ও তাদের পরিবারের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে আমাদের সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে নাগরিক হিসেবে তাদেরও রয়েছে সমঅধিকার।
এ বিষয়ে সকলের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বিশেষত আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেক বেশি সচেতনতা তৈরি করতে হবে যাতে প্রাইমারি থেকে টারসিয়ারি লেভেল পর্যন্ত সবাইকে সমন্বিতভাবে সেবা দেওয়া যায়। এ উদ্দেশ্যে আমাদের মানব সম্পদ ও অর্থ সম্পদের সুষম বণ্টন করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্য সম্পাদন করতে হবে।’
সায়মা ওয়াজেদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের আরো মনে রাখতে হবে, এই শিশুদের পারিবারিক এবং সমাজ জীবনে সমভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। এজন্য পরিবার, বাড়ি ও স্কুলে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। উন্নত সেবার মানদণ্ড নির্ণয় এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং সমাজসেবা সেক্টরসমূহের সঙ্গে পেশাজীবী, অ্যাডভোকেট ও পরিবারের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এ বিষয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।’
‘এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর ন্যায় বাংলাদেশেও নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবলিটিজ, অটিজম এবং শিশুদের মনঃস্বাস্থ্যের বিষয়ে ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণ রয়েছে। এমনকি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের মধ্যেও রয়েছে। এছাড়া যে সব কর্মকর্তা অটিজম বিষয়ক নীতিনির্ধারণের বিষয়ে সম্পর্কিত রয়েছেন তাদেরও রয়েছে সীমাবদ্ধতা। আমি মনে করি, প্রতিবন্ধিতার ইতিহাসে বাংলাদেশ এখন যুগসন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছে। বিশেষ করে, আমাদের এই জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়ন এবং পরিবর্তনের জন্য আমাদের যথোপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ এখন জরুরি। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি বাস্তবমুখি বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং তা যাতে স্থায়ীত্ব পায় সে দিকে আমাদের নজর দিতে হবে।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন বলেন, ‘প্রতিবন্ধীদের বিকাশে আন্তরিকতা ও প্রত্যয়ের বিষয়টিই বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। জাতিসংঘ এ ব্যাপারে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে চলেছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের বিকাশে বিভিন্ন দেশে প্রকল্পভিত্তিক কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।