যতই দিন যাচ্ছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সেনাবাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন বেড়েই চলেছে। জীবন বাঁচাতে নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছেন রাখাইনরা। কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্তেও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে কী করবে এখন এই নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠী? আর কতদিনই বা এভাবে পালিয়ে বেড়াতে হবে তাদের? এ প্রশ্নে উত্তর কারোরই জানা নেই।
সাত মাস আগে নির্বাচিত হয়ে দেশ শাসনের ক্ষমতা পেয়েছে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি)। শান্তির দূত হিসেবে নোবেল পেয়েছিলেন সু চি। অথচ তার দলের জয়ের পর রোহিঙ্গারা আজ নিজের দেশেই বাস্তুহারা। ক্ষমতা হাতে পেয়ে এখন কি তবে নিজের দায়িত্ব ভুলে গেলেন সু চি? তার দেশে এতো বড় অমানবিক ঘটনা ঘটছে, সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার করছে, বাড়ি-ঘরে আগুন দিচ্ছে, রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ এতো কিছু জেনেও মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছেন সু চি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে এখন পর্যন্ত তাকে কোনো কিছু বলতে শোনা যায়নি।
দেশে দেশে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হচ্ছে। শান্তির জন্য নোবেল পেয়েছিলেন সু চি। এখন তো মনে হচ্ছে, তাকে শান্তিতে নোবেল দেয়াটাই ছিল বড় ভুল সিদ্ধান্ত। নিজের দেশেই শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন তিনি। যেহেতু তার নিজের দলই ক্ষমতায় রয়েছেন, তাই চাইলেই তিনি রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বাস্তবসম্মত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। এ নিয়ে সরকারি পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা করাটাও কঠিন কিছু না। অথচ এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটা কিছু বললেন না সু চি। তার এই নীরব থাকাটা তাকে বিশ্বজুড়ে সমালোচনায় ফেলেছে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সেনা অপরাধের বিষয়ে তার অক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।
রাখাইন রাজ্যে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিমের বাস। সেখানে এতদিন পর্যন্ত বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠদের কাছে নির্যাতিত হচ্ছিল রোহিঙ্গা মুসলিমরা। এখন নতুন করে সেনাবাহিনী এই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করেছে। রোহিঙ্গারা বরাবরেই মিয়ানমারের নাগরিত্ব এবং ভোটাধিকারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। তবুও সেখানে কোনো মতে দিন কেটে যাচ্ছিল তাদের। কিন্তু হঠাৎ করেই সেনাবাহিনীর তাণ্ডবে সব হারাতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বিয়ে, পরিবার পরিকল্পনা, কর্মসংস্থান, শিক্ষা এবং চলাফেরার স্বাধীনতায় আর সব সাধারণ নাগরিকদের চেয়ে বৈষম্যের শিকার হয় রোহিঙ্গারা। এক কথায় মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের কোনো অধিকারই নেই। শরণার্থী বা বাস্তুহারা লোকজন একটি দেশে যেভাবে বাস করে রোহিঙ্গারাও মিয়ানমারে ঠিক সেভাবেই বাস্তুহারাদের মতো বসবাস করছে। তবে অনেক দেশেই শরণার্থীদেরও অনেক সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। এ ধরনের সুযোগও রোহিঙ্গারা পায়নি কখনো। চিরকাল তারা নিগ্রহের শিকার হয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রধান জন ম্যাকইসিক অভিযোগ করে বলেছেন, ‘মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন অভিযান চালাচ্ছে।’ বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী।’
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের তাদের দেশের জনগোষ্ঠী বলে স্বীকৃতি দেয় না। তারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী বলে মনে করে।
২০১২ সাল থেকেই রোহিঙ্গাদের ওপর বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠদের নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে শুরু করে। একদিকে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠদের নির্যাতন অপরদিকে সেনাবাহিনীর নির্যাতন। দু’পক্ষের অমানবিক নির্যাতনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারা। জীবন বাঁচাতে তাই প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তারা।
এ বছরের অক্টোবরের শুরুতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে তিনটি পুলিশ চেকপোস্ট হামলার ঘটনায় নয় পুলিশ সদস্য নিহত হয়। ওই হামলার জন্য রোহিঙ্গাদেরই দায়ী করছে মিয়ানমার সরকার। এরই সূত্র ধরে রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে অভিযান শুরু করে সেনারা। অভিযানের নাম করে পুরুষদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে আর গ্রামে গ্রামে কয়েক হাজার বাড়িঘরে আগুন দেয়া হচ্ছে।
এক বিবৃতিতে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থিন খাও সহিংসতার জন্য স্থানীয় জঙ্গি গোষ্ঠী আকামুল মুজাহিদিনকে (এএমএম) দায়ী করেছেন। তিনি এ ধরনের নির্যাতন ও নিপীড়ন মুসলিম অধ্যুষিত রাখাইন এলাকার মধ্যে চরমপন্থি ইসলামী মতাদর্শ প্রচার করার প্রচেষ্টা বলে উল্লেখ করেছেন।
ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এএমএম এ ধরনের সহিংসতা তৈরিতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠার থেকে অর্থ সহায়তা পাচ্ছে। অর্থাৎ তার বিবৃতি অনুযায়ী, এএমএমই সব ধরনের বর্বরতা চালাচ্ছে সেনারা নয়। তাহলে যে রোহিঙ্গারা দেশ থেকে পালিয়ে এসে সেনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে তারা কি মিথ্যা বলছে? জীবনের ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো মানুষ কখনো মিথ্যা বলতে পারে? এর উত্তর জানা নেই। তবে এইটুকু বলা যায়, ক্ষমতায় থাকা উচ্চাভিলাষী মানুষগুলো বরাবরই মিথ্যা বলে। তারা একরকম প্রতিশ্রুতি দেয় আর কাজের বেলায় করে ভিন্ন কিছু।
পুলিশ চেকপোস্টে হামলার ঘটনার পর হেলিকপ্টারে করে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালায় সেনাবাহিনী। সেনাদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ এবং লুটপাটের অভিযোগ এনেছে রোহিঙ্গারা। গত চার বছরে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকার সবচেয়ে বেশি বর্বর আচরণ দেখালো।
নভেম্বরে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসা সু চি সরকার সেনাবাহিনীর বর্বতার ঘটনা নাকচ করে দিয়েছে। এ বিষয়ে সু চির কার্যালয় থেকেও সন্তোষজনক কিছু বলা হয়নি। এসব ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে, সেনাবাহিনীর ওপর সু চির সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই অথবা নীরব থেকে সু চি সরকার সেনাবাহিনীর বর্বরতাকে সমর্থনই জানাচ্ছে।
রয়টার্সের এক খবরে জানানো হয়েছে, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে গত সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে জাতিসংঘে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার এবং নিপীড়ন বন্ধে সু চি সরকারের অক্ষমতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
রাখাইন রাজ্যে কোনো সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিককে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে ওই এলাকার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানা সম্ভব হচ্ছে না। ওই এলাকায় মানবিক সহায়তা এবং নিরপেক্ষ সাংবাদিককের প্রবেশের অনুমতি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ এবং হিউমেন রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
এতদিন পর্যন্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বজুড়ে এক আদর্শের নাম ছিলেন গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সাং সু চি। আজ তার দেশেই গণতন্ত্র উধাও। রাখাইন রাজ্যে গণতন্ত্রের ছিটেফোটারও অস্তিত্ব নেই। এসব কারণেই সম্প্রতি সু চির কাছ থেকে নোবেল কেড়ে নেয়ার দাবি উঠেছে। বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় সু চির বিবেককে কতটুকু নাড়া দেয়- এখন সেটাই দেখার অপেক্ষা।