যুদ্ধাপরাধীর সহচর থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক’

যুদ্ধাপরাধীর সহচর থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক’

1এরশাদ সরকারের আমলে একবার সিলেটে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছিলো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে। এসময় সাঈদীকে সিলেটে প্রতিরোধেরও ডাক দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা-জনতাসহ প্রগতিশীল শক্তির নেতৃত্বে সর্বস্তরের সিলেটবাসীর এই প্রতিরোধ কর্মসূচি মোকাবেলা করার সাহস পায়নি জামায়াত-শিবির। তখন সাঈদীর পাশে দাঁড়ান শিল্পপতি রাগীব আলী।

অবাঞ্ছিত সাঈদীকে বিমানে সিলেট নিয়ে আসা, নিজ এলাকা কামালবাজারে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা এবং নিজ মালিকানাধীন মালনীছড়ায় আতিথেয়তার ব্যবস্থা করেন রাগীব আলী। রাগীব আলীর পৃষ্টপোষকতায় সিলেটে আসেন যুদ্ধাপরাধী সাঈদী।

কেবল সাঈদীর পৃষ্ঠপোষকতা নয়, বিভিন্ন সময়ই জামায়াত-শিবিরসহ মৌলবাদী ও স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আবির্ভূত হন এই ধনকুবের। অথচ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু হলে হঠাৎ ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক’ বনে যান রাগীব আলী। সেসময় তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতারাও সংবর্ধনা দেন রাগীব আলীকে।

এসময় নিজের মালিকানাধীন গণমাধ্যম দৈনিক সিলেটের ডাকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেকে ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক’ হিসেবে পরিচিত করা শুরু করেন।

তবে ইন্টারনেটভিত্তিক মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়াতে রাগীব আলীর একাত্তরের ভূমিকা সম্পর্কে লেখা রয়েছে ‘রাগীব আলী সম্পর্কে বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে থেকে দেশের বিরুদ্ধে কাজ করা, যুদ্ধাপরাধীদের সহায়তা করা ও হিন্দুদের দেবোত্তর সম্পত্তি দখল প্রভৃতি।’

ছয় মাস আগে কথিত এই দানবীর রাগীব আলীকে ‘যুগশ্রেষ্ঠ দানবীর, সমাজসেবার কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব’ আখ্যা দিয়ে তাকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা পদক দেয়ার দাবি তুলেছিলেন এক শ্রেণির সমাজপতিরা। আর ছয় মাসের মাথায় জামায়াত-শিবিরের পৃষ্ঠপোষক রাগীব আলীকে দেবোত্তর সম্পত্তি দখল ও জালিয়াতির দুই মামলায় কারাগারে যেতে হলো।

তবে রাগীব আলীর কাছ থেকে সুবিধা নেয়া সমাজপতিরা এখন আর তার খবর নিচ্ছেন না। সমান দূরত্বে সটকে পড়েছেন তারা। এ নিয়ে সিলেটে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে।

বহুল আলোচিত এই শিল্পপতির জীবিত অবস্থায় যে পরিমাণ প্রশংসা ও বিভিন্ন সময়ে এতো এতো গুণকীর্তন আর কোনো বাঙালিকে নিয়ে হয়েছে কী-না এ নিয়ে গবেষণার দাবি রাখে! অনুসারীদের সার্বক্ষণিক গুণকীর্তনের মধ্যে থাকা তারকা রাজনীতিবিদদেরও হার মানতে হতো রাগীব আলীর কাছে।

এক পর্যায়ে তাকে ওই চাটুকার শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা তাকে ‘সৈয়দ’ এবং প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক’ উপাধি দিয়ে বসেন। রাগীব আলীও এ মুখরোচক বিশেষণ পছন্দ করতেন।

তাকে নিয়ে বই, পত্রিকায় কত কলাম, ডকুমেন্টারি, গান, কবিতা লেখা হয়েছে তা সংখ্যায় তো কয়েক শতাধিক হবে। রাগীব আলীকে নিয়ে লিখেননি এমন লেখক-বুদ্ধিজীবী খুব কমই খোঁজে পাওয়া যাবে। আর বিশেষণের বাহার তো রয়েছেই।

যুগশ্রেষ্ঠ দানবীর, সমাজসেবার কিংবদন্তী আরো কত কী! তার মালিকানাধীন পত্রিকায় রাগীব আলীর বিশেষণ লিখতে লিখতেই তো প্রথম পৃষ্ঠা শেষ হয়ে যেতো। যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত রাগীব আলীকে প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকও দাবি করতেন তার অনুসারীরা।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের কারণেও আলোচনায় ছিলেন রাগীব আলী। সিলেট বিভাগে রাগীব আলী ও তার স্ত্রীর নামে রয়েছে অর্ধশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

রাগীব আলীর একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়ই দেখা যায়। রাজ সিংহাসনের মতো একটি চেয়ারে বসে আছেন রাগীব আলী। আর চেয়ার সমেত রাগীব আলীকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কয়েকজন যুবক। যেনো পেয়াদাদের কাঁধে চড়ে যাচ্ছেন প্রাচীনকালের কোনো সম্রাট!

নিজের অঢেল সম্পদ, প্রভাব, সকল দলের স্থানীয় নেতাদের অনুকূলে রাখা ও মিডিয়ায় বিনিয়োগের মাধ্যমে অনেকটাই সিলেট অঞ্চলের মুকুটহীন সম্রাট হয়ে ওঠেছিলেন রাগীব আলী।

তবে উত্থান পর্ব থেকেই রাগীব আলীর বিরুদ্ধে রয়েছে প্রতারণা ও অন্যের সম্পত্তি দখলের অভিযোগ। এতদিন রাগীব আলীর প্রভাবের কারণে যা ধোপে টেকেনি। ভয়ে মুখ খুলেননি কেউ। অনেকে আবার সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছেন।

সেই দুর্দণ্ড প্রভাবশালী রাগীব আলীকে ২৪ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) বিমর্ষ, বিধ্বস্ত রূপ দেখলেন সবাই। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আদালতে হাজির করা রাগীব আলী যেনো দুর্দণ্ড প্রতাপশালী কোনো ধনকুবের নয়, যেনো অসহায়, ক্লান্ত এক বৃদ্ধ!

ভারতে পালিয়ে গিয়েও গ্রেফতার এড়াতে পারলেন না রাগীব আলী। বহুল আলোচিত তারাপুর চা বাগান দখলের দুইটি মামলায় জেলে ঠাঁই নিতে হলো তাকে।

Ragib

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার কামাল বাজার এলাকার তালেবপুর গ্রামের বাসিন্দা রাগীব আলী তরুণ বয়সেই যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সেখানেই অবস্থান করেন তিনি। যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালেই প্রচুর সম্পদের অধিকারী হন রাগীব আলী।

রাগীব আলীর ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, আশির দশকের গোঁড়ার দিকে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে আসেন তিনি। শিল্পে বিনিয়োগে উদ্যোগী হন। এসময় সিলেটের মালনীছড়াসহ একাধিক চা বাগান ইজারা নেন রাগীব আলী।

তবে সিলেটে রাগীব আলী প্রথম আলোচনায় আসেন ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে। সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রাবাস ‘ক্রয় করে’ তোপের মুখে পড়েন। সিলেট নগরীর প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র বন্দরবাজারে এক হিন্দু জমিদারের দান করা জমিতে এই ছাত্রাবাস নির্মাণ করেছিল সরকারি পাইলট স্কুল। ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে রাগীব আলী ‘জালিয়াতির মাধ্যমে’ এই ছাত্রাবাস কিনে নিয়েছেন এমন সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সিলেট জুড়ে শুরু হয় ছাত্রাবাস রক্ষা আন্দোলন।

তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ১৯৮৬ সালের দিকে রাগীব আলী এই ছাত্রাবাসের ভূমিতে গড়ে তোলেন ‘মধুবন’ নামে বিপণী বিতান। এই মার্কেটটি এখনো রয়েছে।

তৎকালীন ছাত্রাবাস রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও জাসদ সিলেট মহানগর শাখার সভাপতি অ্যাড. জাকির আহমদ বলেন, জমিটি সরকারি স্কুল থেকে দান করেছিলেন এক হিন্দু জমিদার। দানের জমি বিক্রি করা যায় না। তবু কোনো টেন্ডার ছাড়াই তৎকালীন সামরিক সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে জালিয়াতির মাধ্যমে রাগীব আলী এই জমিটি কিনে নেন।

তিনি বলেন, এসময় ছাত্রাবাস রক্ষায় রাগীব আলীর বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব আন্দোলন শুরু হয়। তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের প্রায় সকলেই এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। আন্দোলনের কারণে তিন বছর রাগীব আলী এই জমি দখল করতে পারেন নি।

পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালের দিকে অন্য একটি মামলায় সামরিক সরকার আমাদের অনেককে জেলে ঢুকিয়ে দেয়। এছাড়া আন্দোলনকারীদের অনেকেও বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে রাগীব আলীর সঙ্গে আঁতাত করে নেন। এই সুযোগে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রাবাসের ভূমি দখল করে নেন রাগীব আলী।

তারাপুর চা বাগান দখল
সিলেটে রাগীব আলী নাম আসলেই তারাপুর চা বাগান দখলের বিষয়টি ওঠে আসে। দীর্ঘকাল ধরেই রাগীব আলীর তারাপুর চা বাগান দখলের কাহিনী লোকমুখে প্রচারিত হয়ে আসলেও তার প্রতিপত্তি ও প্রমাণের অভাবে কেউ প্রকাশ্যে এ নিয়ে মুখ খোলেন নি। উল্টো আর্থিক প্রতিপত্তি, নিজ মালিকানার গণমাধ্যম ও নিজের বলয়ের বুদ্ধিভিত্তিক চর্চাকারীদের কল্যাণে ‘দানবীর’ হিসেবে পরিচিত হতে থাকেন রাগীব আলী।

তবে গত ১৯ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নের্তৃত্বাধীন উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগের এক রায়ে রাগীব আলীর প্রতারণার বিষয়টি ওঠে আসে।

দীর্ঘকাল ধরে চলা এই মামলার রায়ে বলা হয়, রাগীব আলীর প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে দেবোত্তর সম্পত্তি রাগীব রাবেয়া চা বাগান দখল করেছেন। এই বাগান দেবোত্তর সম্পত্তির সেবায়েতকে ফিরিয়ে দেয়া ও বাগান ধ্বংস করে নির্মিত সকল স্থাপনা অপসারণেরও নির্দেশ দেন আদালত। বাগানের ক্ষতি করার জন্য রাগীব আলীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়েরও নির্দেশ দেন আদালত।

তবে আদালতের রায়ের ১৭ বছর আগেই প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার দেবোত্তর সম্পত্তি তারাপুর চা বাগান শিল্পপতি রাগীব আলীর কাছ থেকে উদ্ধারের জন্য সুপারিশ করেছিল তৎকালীন সংসদীয় কমিটি। এছাড়া এই বাগানে গড়ে তোলা রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করে ও ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালনার সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটি।

২০০৯ সালে এই বিষয়ে গঠিত সংসদীয় সাব কমিটি এসব সুপারিশ করে। তবে ১৭ বছরেও আমলে নেয়া হয়নি কমিটির সুপারিশ। প্রতারণার মাধ্যমে ভূ-সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাগীব আলীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।

তৎকালীন সিলেট সদর ভূমি কমিশনার এসএম আব্দুল হাই কোতোয়ালী থানায় এ মামলাটি দায়ের করেন। মামলা নং-১১৭/০৫। দীর্ঘদিন স্থগিত আদালতের নির্দেশে পুনরায় এই মামলার কার্যক্রম শুরু হয়।

গত ১০ আগস্ট এই মামলায় রাগীব আলী, তার ছেলে-মেয়েসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে গ্রেয়তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। এই পরোয়ানা জারির পরপরই গ্রেফতার এড়াতে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারত পাড়ি দেন রাগীব আলী।

তালেবপুর থেকে রাগীব নগর
রাগীব আলী যে গ্রামে জন্মেছেন তার নাম তালেবপুর। এই গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা ও হাসপাতাল নির্মাণ ও রাস্তাঘাট সংস্কারে অনুদান দেন রাগীব আলী। এছাড়া নিজের মালিকানাধীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লিডিং ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস, রাগীব-রাবেয়া স্পোর্টস একাডেমিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন রাগীব আলী।

তবে এসব প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ও কাগজপত্রে এলাকার নাম তালেবপুরের বদলে লেখা রয়েছে- রাগীবনগর। গত প্রায় এক দশক ধরে প্রাচীন একটি এলাকার নাম বদলে নিজের নামে নামকরণের চেষ্টা চালান রাগীব আলী। তার মালিকানাধীন সংবাদপত্রে তালেবপুরের নাম লেখা হয়- রাগীবনগর।

এর বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে ওই এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা আদালতে মামলা করেন। গত বছরের আগস্টে সিলেটের সহকারী জজ আদালতের রায়ে এই নাম পরিবর্তনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। তবে পরবর্তীতে জজ আদালত রাগীবনগরের পক্ষে রায় দেন। বর্তমানে এই মামলাটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন আছে।

জেলা সংবাদ