ঢাকা: স্থানীয় সরকার পর্যায়ে তিন শতাধিক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি গত আড়াই বছরে বরখাস্ত হয়েছেন। আরও শতাধিক প্রতিনিধি বরখাস্ত হওয়ার আতংকে দিন কাটাচ্ছেন। তারা শত শত মামলা মাথায় নিয়ে ঘুরছেন। এদের অধিকাংশই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ভোট কেন্দ্রে আগুন, গাড়িতে পেট্রল দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, পুলিশের ওপর হামলাসহ রাজনৈতিক সহিংসতার মামলার আসামি তারা। এর মধ্যে চারজন সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, ২১ পৌর মেয়র, ৪৪ কাউন্সিলর, উপজেলা চেয়ারম্যান ৪৭ জন, ভাইস চেয়ারম্যান ৫৮ জন, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ৮৬ ও মেম্বার ৫৪ জন। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে গড়ে তিনটির বেশি মামলা রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের বাইরের বাকি জনপ্রতিনিধিরাও মামলাসহ নানা চাপে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে স্থানীয় সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। সেবা বঞ্চিত হচ্ছে ওই এলাকার জনগণ। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, পদগুলো দখলের উদ্দেশ্যেই মামলা ও হয়রানি করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সরকার কোনো জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। যদি কোনো জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে নাশকতা কিংবা যে কোনো মামলায় চার্জশিট দাখিল এবং তা আদালতে গৃহীত হয়, তখন সেই জনপ্রতিনিধিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সাময়িক বরখাস্ত করে। জনপ্রতিনিধি হয়ে অগ্নিসংযোগ ও মানুষ পুড়িয়ে মারলে তারা তো আইন অনুযায়ী বরখাস্ত হবেন এটাই স্বাভাবিক।’
প্রসঙ্গত, বিদ্যমান স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন), স্থানীয় সরকার (পৌরসভা), স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) এবং স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন অনুযায়ী কোনো জনপ্রতিনিধি যে কোনো ধরনের ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হলে (আদালত কর্তৃক চার্জশিট গৃহীত হলে) কিংবা ওই প্রতিনিধি শারীরিকভাবে সক্ষমতা হারালে কিংবা পরিষদের সভায় পরপর তিনবার অনুপস্থিত থাকলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সরকারের চলতি মেয়াদে ভোট কেন্দ্রে আগুন, গাড়িতে পেট্রল ছিটিয়ে আগুনে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, পুলিশের ওপর হামলাসহ একাধিক মামলায় ৩১৪ জন জনপ্রতিনিধি সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। তবে এ সংখ্যা কিছু কম-বেশিও হতে পারে। আদেশে সুনির্দিষ্টভাবে মামলার ধরন উল্লেখ না থাকলেও রাজনৈতিক সহিংসতার মামলার আসামি হওয়ার কারণেই বেশিরভাগ বরখাস্ত হয়েছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা হরতাল-অবরোধে নাশকতা আর বোমাবাজির ঘটনায় বহু জনপ্রতিনিধিকে আসামি করে মামলা করা হয়। এরপর গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত টানা তিন মাস ধরে চলা অবরোধ-হরতালে নাশকতা, বোমাবাজি ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার মামলায় আসামি করা হয় বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের। এসব মামলা তদন্ত শেষে পাঁচ শতাধিক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আদালতে চার্জশিট গৃহীত হওয়ার পরপরই সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে। এ সুযোগে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্যানেল মেয়রের তালিকায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতারা। তবে বরখাস্তকৃতদের অনেকে উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে দায়িত্বও ফিরে পেয়েছেন। তবে দায়িত্ব ফিরে পেলেও অনেকেই চেয়ারে বসতে পারছেন না।
দলীয় মামলা দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপির কেন্দ্রীয় আইনবিষয়ক সম্পাদক সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ‘সারা দেশেই আমাদের সমর্থিত সিটি মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, ইউপি চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিরা বরখাস্ত হচ্ছেন। মিথ্যা মামলায় অভিযোগপত্র দিয়ে এরই মধ্যে তিন শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করেছে ক্ষমতাসীন সরকার। আরও কয়েকশ’ জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত হওয়ার আতংকে দিন কাটাচ্ছেন।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘যারা এখনও বরখাস্ত হননি তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। মামলার কারণে তারা জনগণের সেবা দিতে পারছেন না। বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ।’
মহাজোট সরকারের সময় অনুষ্ঠিত রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়ররা নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরই মধ্যে তাদের ৪ জন সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় চার্জশিটভুক্ত হওয়ায় গত বছরের ৭ জানুয়ারি সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পুলিশের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন নাশকতা মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি হওয়ায় রাজশাহী সিটি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে বরখাস্ত করা হয় ৭ মে। তার বিরুদ্ধে আরও ৫টি মামলা চলছে। ১৯ আগস্ট গাজীপুরের মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে। একই অভিযোগে ২ নভেম্বর খুলনা সিটি মেয়র মনিরুজ্জামানকে বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে একাধিক মামলা। বিএনপির মনোনীত হওয়ার পরও দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ক্ষমতাসীনদের নানাভাবে ম্যানেজ করে চেয়ার টিকিয়ে রেখেছেন বলে গুঞ্জন আছে। এছাড়া বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনের ৪৪ জন কাউন্সিলরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কোনো অপরাধে মামলা হলে তার শাস্তি হতেই পারে। কিন্তু বিরোধীপক্ষকে ঘায়েল করতে ও রাজনৈতিক ময়দান থেকে দূরে রাখতে মিথ্যা মামলা দেয়া ঠিক নয়। এ ধরনের মামলাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে বরখাস্ত করাও কারও কাম্য নয়। রাজনীতির এই চর্চা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এটি গণতন্ত্রচর্চার জন্য সুখকর নয়। স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে চাইলে বিদ্যমান আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার সুবিধা-অসুবিধাগুলো পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সাময়িক বরখাস্ত হওয়া জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে দিনাজপুরে ১৮ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৩, সাতক্ষীরায় ১৮, কক্সবাজারে ১৯, বগুড়ায় ২৭, রাজশাহীতে ১৭, কুষ্টিয়ায় ১১, চট্টগ্রামে ১৯, পাবনায় ১২, সিরাজগঞ্জে ৭, গাইবান্ধায় ২৪, রংপুরে ২৩, পিরোজপুরে ৪, হবিগঞ্জে ৭, নাটোরে ৯, জয়পুরহাটে ৫, ঠাকুরগাঁওয়ে ৮, পঞ্চগড়ে ৬, খাগড়াছড়িতে ৩, বান্দরবানে ৪, চাঁদপুরে ৪, ময়মনসিংহে ৩, শরীয়তপুরে ১, নড়াইলে ১, সিলেটে ২ জন এবং মাগুরায় একজন।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এটা তো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে। একই সঙ্গে জনগণের ম্যান্ডেটকে ভণ্ডুল করা হচ্ছে। এটা গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। গণতন্ত্রের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। সরকারের সদিচ্ছাই পারে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে। সরকার এগুলো থেকে বিরত না হলে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়বে এবং এর পরিণতি ভালো হবে না।
হয়রানির বিষয়ে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া গাবতলীর উপজেলা চেয়ারম্যান মোর্শেদ মিল্টন বলেন, গাবতলীর মেয়র থাকাবস্থায় ২০১৩ সালের নাশকতার মামলার চার্জশিট হওয়ায় তাকে বরখাস্ত করা হয়। আদালতের মাধ্যমে চেয়ার ফিরে পেলেও গত আগস্টে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে ফেরারি হন তিনি। এই সুযোগে উপজেলা পরিষদের পরপর তিনটি বৈঠকও করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। ৩ বৈঠকে অনুপস্থিত থাকার বিষয় নিশ্চিত করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি দেন তিনি। এ কারণে আবারও চেয়ার হারাতে যাচ্ছেন এই উপজেলা চেয়ারম্যান।
বরখাস্ত হওয়া সাতক্ষীরা পৌরসভার মেয়র ও জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক তাজকিন আহমেদ বলেন, ২০১৩ সালের গাড়ি পোড়ানোর একটি মামলায় তার বিরুদ্ধে চার্জশিট হয়। এ কারণে দায়িত্ব নেয়ার আড়াই মাসের মাথায় সাময়িক বরখাস্ত হন। আদালতের মাধ্যমে চেয়ার ফিরে পেলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ এই মেয়রের। তিনি বিএনপি মনোনীত হওয়ায় নানাভাবে সমস্যা তৈরি করা হচ্ছে। জনগণকে কাক্সিক্ষত সেবাও দিতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেন এই পৌর মেয়র।যুগান্তর