পোল্ট্রিশিল্প বাঁচাতে এখুনি ব্যবস্থা চাই

পোল্ট্রিশিল্প বাঁচাতে এখুনি ব্যবস্থা চাই

নানা সংকটে দেশের পোলট্রি শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়েছে। এতে করে সংশ্লিষ্ট খামার মালিক, ব্যবসায়ীরা পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকেই মূলধন হারিয়ে পথে বসেছেন। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আশু পদক্ষেপ নিলে এখনো লাখ লাখ মানুষকে এ পেশায় টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

গত দুই বছরে দেশের দেড় লাখ মুরগির খামারের মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী তিন মাসে বাকি খামারগুলোও বন্ধ হয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কা খামারিদের।

তারা বলছেন, উৎপাদন খরচ, খাদ্য, ওষুধ, বাচ্চার দাম বেড়ে যাওয়া, বার্ড ফ্লু সংক্রমণসহ নানা কারণে পোলট্রি শিল্পের উদ্যোক্তারা এই পেশা থেকে সরে আসছেন। কেউ কেউ অন্য ব্যবসায় মনোনিবেশ করলেও বেশিরভাগ খামারিকে মূলধন হারিয়ে পথে বসতে হয়েছে।

এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে সরকারের আশু পদক্ষেপ চেয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না দাবি করে খামারিরা বলছেন, সরকার সহজ শর্তে পাশের দেশ ভারত দেশ থেকে ডিম ও মুরগির বাচ্চা আমদানির সুযোগ করে দিচ্ছে। এতে দেশীয় খামারের উৎপাদিত ডিম ও মুরগির প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন ক্রেতারা।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, ২০১০ সালে দেশে মুরগির খামারের সংখ্যা ছিল দেড় লাখ। এই সংখ্যা কমে গিয়ে ৬০ থেকে ৭০ হাজারে দাঁড়িয়েছে।

২০১১ সালে প্রতি সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগি উৎপাদন হতো ৯০ লাখ, এখন হয় ৪৫ লাখ। একই বছর লেয়ার মুরগির উৎপাদন ছিল ১০ লাখ, এখন হয় মাত্র দুই থেকে আড়াই লাখ। এখন প্রতি সপ্তাহে চার লাখ ব্রয়লার মুরগি এবং ৫০ হাজার লেয়ার মুরগি কম উৎপাদন হচ্ছে।

এই খাতে এক সময় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হতো, এখন হয় প্রায় ২০ লাখ মানুষের।

খামারিরা জানান, বার্ড ফ্লু আতঙ্ক বা অন্য যে কোনো রোগে আক্রান্ত হলে ডিম পাড়া অবস্থায় বা যে কোনো বয়সেই মুরগি বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া মুরগির খাদ্যের দাম বেশি, ব্যাংকঋণ না পাওয়ার কারণে পোলট্রিশিল্প ছেড়ে অন্য পেশায় যাচ্ছে খামারিরা।

তারা জানান, সরকার পোলট্রিশিল্প রক্ষায় পুরোপুরি উদাসীন। যেখানে সারা দেশের মুরগির খামার বার্ড ফ্লু ঝুঁকিতে রয়েছে, সেখানে কেবল ঢাকায় কয়েকটি মার্কেটে অভিযান চালানো অনর্থক। গোড়াতেই রোগা মুরগি শনাক্ত করতে না পারলে এটা আরো ছড়াবে।

তারা অভিযোগ করেন, সরকার বিনা শুল্কে পাশের দেশ থেকে ডিম আমদানির ব্যবস্থা করে দিয়ে এ শিল্প বন্ধ করার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করেছে। মার্চ মাসেই সেখান থেকে এসেছে কয়েক লাখ ডিম। হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে এই আমদানির সুযোগ দিচ্ছে সরকার।

খামারিরা জানান, অনেকে খামারের যন্ত্রাংশ বিক্রি করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারি (হ্যাচারি) ও খাদ্য ব্যবসায়ীরাও লোকসানে পড়েছেন, পেশা পাল্টাচ্ছেন তারাও।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল ড. এমএম খান বলেন, ‘পার্শ্ববর্তী দেশে সবখানে বার্ড ফ্লুর ভ্যাকসিনেশন ব্যবস্থা নেওয়া হলেও আমাদের দেশে বৈধভাবে তা আমদানির সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। বার্ড ফ্লু রোধ করার কোনো পদক্ষেপ নেই সরকারের।’

এ শিল্প রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীকে তারা চিঠিও দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে অনেকটা হতাশ বলে জানান ড. খান।

বাংলাদেশ পোলট্রি শিল্প রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মহসিন, এক সময় গাজীপুর থেকে মুরগির মাংস ও ডিম সরবরাহ করে দেশের বড় চাহিদা পূরণ করা হতো। গত দেড় বছরে এখানে ছয় হাজার ২৩৩টি মুরগির খামার বন্ধ হয়ে গেছে। গত বছর জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ধ হয় চার হাজার ৩৪৫টি খামার। এ বছরও বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে বেশ কয়েকটি বন্ধ হয়ে গেছে। গাজীপুরের শ্রীপুরে বেশ কয়েকটি মুরগির খামার রয়েছে মহসিনের।

খামারিদের মতে, শুরুর দিকে ভালো ব্যবসা হয়েছে। ২০০৭ সালের ২২ মার্চ প্রথম বার্ড ফ্লু সংক্রমণ হলে নিজেরা প্রতিরোধের চেষ্টা করে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তেমন জোরালো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এতে প্রচুর মুরগি মারা যায়। এতে লোকসানের কারণে তারা খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ আবু সিদ্দিকী বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে ২০০৫ সালে পোলট্রিজাত পণ্য বিদেশে রফতানি করা হতো। কিন্তু ২০০৭ সালের পর বন্ধ হয়ে যায়।’

তিনি দাবি করেন, ‘এ শিল্প রক্ষায় ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচি হাতে নেওয়া ও ভারত থেকে ডিম আমদানি বন্ধ করতে হবে। এতে দেশীয় উদ্যোক্তারা ভালোভাবে উৎপাদন করতে পারবে। ফলে খাতের সংশ্লিষ্টরা বেকারত্বের বৃত্তে ঘুরপাক খাবে না। আমরা অর্থনীতিতেও ভালো অবদান রাখতে পারবো।’

তিনি আরো বলেন, বেশির ভাগ খামার বন্ধ হওয়া এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে এখন মাংস ও ডিমের দাম বেশি। এ অবস্থা চলতে থাকলে দাম আরো বাড়বে। তাই সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশ