আজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই নয় বরং পুরো বিশ্বেই নির্বাচনী হাওয়া বিরাজ করছে। সারা বিশ্বের মানুষ আজকের নির্বাচনের দিকে অধীর আগ্রহে চেয়ে আছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুই প্রার্থী ডেমোক্রেট দলের হিলারি ক্লিনটন এবং রিপাবলিকান দলের ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। হিলারি বা ট্রাম্পকে নিয়ে কি ভাবছে বিশ্বের মানুষ তাই দেখে নিন।
ইউরোপ
ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কাছে মার্কিন প্রেসিনডেন্টের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। তবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ট্রাম্পের চেয়ে হিলারিই বেশি জনপ্রিয়। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের স্কটিশ বংশোদ্ভূত জার্মান সাংসদ ডেভিড ম্যাকঅ্যালিস্টার বলেছেন, ‘আমরা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিশেষ চিনি না, ওর সম্পর্কে বিশেষ জানি না। ইউরোপে আমরা স্বভাবতই হিলারি ক্লিনটনকেই বেশি চিনি। তার সহযোগিতা থেকে আমরা অনেক কিছু পেতে পারি।’
এদিকে, জার্মানির অধিকাংশ মানুষই মনে করেন ক্লিনটন সৎ এবং তিনি পরোপকারী। রক্ষণশীল সিডিইউ দলের এক সদস্য বলেছেন, আমি মার্কিন ভোটারদের বলব, দু’টো খারাপের মধ্যে কম খারাপটা বেছে নিতে। দুনিয়ায় নিখুঁত বলে তো কিছু নেই। ট্রাম্পের মত কাউকে ভোট দেয়া যায় না। অনেক জার্মানির মতেই ট্রাম্প বা হিলারির চেয়ে আরো ভালো এবং যোগ্য কাউকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল।
সাবেক মার্কিন পররাষ্টমন্ত্রী হিসেবে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে ইউরোপের বহু রাজনীতিকের ব্যক্তিগত পরিচয় রয়েছে। তাই পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসাবে হিলারি জয়ী হলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো এগিয়ে যাবে।
রাশিয়া
মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়া প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছে বলে এর আগে অভিযোগ করেছেন হিলারি। হিলারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিরোধ তৈরি হয়। এদিকে, আরেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ট্রাম্প বলেছেন, প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হলে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে আরো সৈন্য মোতায়েন করে রাশিয়াকে ওই অঞ্চলে আরো বেশি প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ দেবেন। তার এই ঘোষণার ফলে রাশিয়া এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার সখ্য তৈরি হয়েছে।
এক জনমত জরিপে অনুযায়ী, ২২ শতাংশ রুশ নাগরিক ট্রাম্পকে পছন্দ করেন। আর হিলারির পক্ষে আছেন মাত্র ৮ ভাগ। তাই ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের বরফ গলতে পারে। অপরদিকে, হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে সম্পর্কের কোনো উন্নতি হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আফ্রিকা
আফ্রিকার দেশগুলোতেও মার্কিন নির্বাচন নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। বিশেষ করে নাইজেরিয়ার মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় হিলারি। তারা মার্কিন নির্বাচনে জনমত জরিপে কে এগিয়ে আছে তা নিয়ে বেশ আগ্রহী।
মেক্সিকো
মেক্সিকোর কাছে মার্কিন নির্বাচন বেশ গুরুত্ব বহন করে। এক নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প বলেছেন, মেক্সিকোর শরণার্থীরা চোর এবং ধর্ষক। তিনি নির্বাচিত হলে মেক্সিকোর সঙ্গে সীমান্তে প্রাচীর দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তার এ ধরনের মন্তব্যে স্বাভাবিকভাবেই মেক্সিকোবাসী বেশ ক্ষিপ্ত। তাই তার চেয়ে হিলারিকেই পছন্দ তাদের। ট্রাম্প জয়ী হলে দু’দেশের মধ্যে দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
চীন
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পকে খুব ভালো চোখে দেখছে না চীন। কিছুদিন আগেই চীন সম্পর্কে অভিযোগ করে ট্রাম্প বলেছিলেন, চীন যুক্তরাষ্ট্রের চাকরি হাতিয়ে নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতামূলক বাজার ধ্বংসের জন্য চীন বৈশ্বিক উষ্ণতার ধারণা উদ্ভাবন করেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। নানা সময়ে চীনের প্রতি বিরূপ মন্তব্য করে চীনাদের চটিয়েছেন ট্রাম্প। আর একারণে তার চেয়ে হিলারির প্রতিই বেশিরভাগ চীনা নাগরিকের আগ্রহ রয়েছে। এক জরিপ অনুযায়ী, হিলারির প্রতি সমর্থন রয়েছে ৩৭ শতাংশ এবং ট্রাম্পের প্রতি ২২ শতাংশ।
ব্রিটেন
ব্রিটেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ ভালোই সখ্য রয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণে নানা অদল-বদল হতে পারে। আর এই প্রভাবটা ব্রিটেনের ক্ষেত্রেও থাকবে। ব্রিটেনের অনেক নাগরিকই ট্রাম্পের জেতার বিষয়ে বেশ আতঙ্কিত। বেশ কিছুদিন আগে ব্রিটেনের পার্লামেন্টের এক আলোচনায় ট্রাম্পকে ব্রিটেনে ঢুকতে দেয়া হবে না বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। এতে করে ট্রাম্পের সঙ্গে বিরোধ কিছুটা শুরু হয়েই গেছে। তাই ট্রাম্প যদি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন তবে দু’দেশের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না।
তবে বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। কারণ একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ইউরোপের একটি দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না -এটা কখনোই সম্ভব হবে না। আর তাই সবকিছু মিলিয়ে হিলারি প্রেসিডেন্ট হলেই ব্রিটেনের জন্য সুখের বার্তা বয়ে আনবে। তাই ট্রাম্পকে চাইছে না ব্রিটেনবাসী। এক্ষেত্রে হিলারির জয়ের দিকেই তাকিয়ে আছে ব্রিটেন।
বাংলাদেশ
মার্কিন নির্বাচন বাংলাদেশের জন্যও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপির ঘরে বিরাজ করছে এক রকমের উচ্ছ্বাস। ঝিমিয়ে পড়া বিএনপিতে এমন উচ্ছ্বাসের কারণ হলো- হিলারি ক্লিনটন। হিলারি ক্ষমতায় আসতে পারেন- এমন সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই বিএনপিতে এখন চলছে নতুন জল্পনা-কল্পনা।
যুক্তরাষ্ট্রের এই নির্বাচনে হিলারি ইস্যু বিএনপির কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পেছনে আরো যে কারণটি রয়েছে তা হলো- অধ্যাপক ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের মতপার্থক্য।
অন্যদিকে বিএনপির মধ্যকার আরেকটি অংশ মনে করছে- আসলে বিদেশনির্ভর রাজনীতিতে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হবে -এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতে কে ক্ষমতায় এলো বা এলো না তাতে ওইসব দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে যে আমূল পরিবর্তন হয়- এমনটা লক্ষ্য করা যায়নি। বরং যেই প্রেসিডেন্ট হন না কেন দু’দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় থাকবে এমনটাই সবার আশা।
ভারত
ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বেশ দৃঢ়। বিশেষ করে ওবামা সরকারের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্পর্ক বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ। তাই মার্কিন নির্বাচন ভারতের জন্যও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হিলারি বা ট্রাম্প কে ভারতের জন্য সুফল বয়ে আনবে সেটা নিয়েও ভাবছেন রাজনীতিবিদরা। অনেকের ধারণা হিলারি জিতলে পারিবারিক ভিসা প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত হবে, আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যুক্তদের গ্রিনকার্ডের সুযোগ বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন সংস্থা খুললে সহজে ভিসার নিয়ম শিথিল করার কথা বলেছেন হিলারি। এতে করে সহজেই স্থায়ী বাসিন্দার মর্যাদা পাবেন ভারতীয়রা।
অপরদিকে, ট্রাম্প জয়ী হলে কাশ্মির ইস্যু, চীন ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের করের হার হ্রাস করা হবে। আমেরিকায় কর্পোরেট করের হার বর্তমানে প্রায় ৩৯ শতাংশ। ট্রাম্পের মতে এতে বিনিয়োগে উৎসাহ কমে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের একাংশ এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। তাই ট্রাম্প বিনিয়োগকারীদের করের হার ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে চান। আমেরিকায় বিনিয়োগে আগ্রহী ভারতীয়দের কাছে এর থেকে ভালো খবর আর কি হতে পারে।