ঢাকা, ৩০ অক্টোবর ২০১৬ : অভিষেক টেস্টে ৭ উইকেট নেয়ার পর ঢাকা টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে ১২ উইকেট নিলেন বাংলাদেশের অফ-স্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজ। তার এমন দুর্ধর্ষ বোলিং নৈপুণ্যে ঢাকা টেস্টে ইংল্যান্ডকে ১০৮ রানের বড় ব্যবধানে হারালো টাইগাররা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই প্রথম টেস্ট ম্যাচ জয়ের স্বাদ নিলো বাংলাদেশ। আর টেস্ট ইতিহাসে অষ্টম জয়ের স্বাদ পেলো টাইগাররা।
সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টের তৃতীয় দিন লাঞ্চের পর জয়ের জন্য ইংল্যান্ডকে ২৭৩ রানের টার্গেট দেয় স্বাগতিক বাংলাদেশ। সেই লক্ষ্যে তৃতীয় দিনেই ১৬৪ রানে অলআউট হয়ে হারের লজ্জা পেতে বাধ্য ইংলিশরা। প্রথম ইনিংসে ২২০ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে ২৯৬ রান করেছিলো বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ড করেছিলো ২৪৪ রান। সিরিজের প্রথম ম্যাচ ২২ রানে জিতেছিল ইংল্যান্ড। আর এই টেস্ট জিতে দুই ম্যাচের সিরিজ ১-১ সমতায় শেষ করলো মুশফিকুর বাহিনী।
মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচে আজ মধ্যাহ্ন বিরতির পর দ্বিতীয় ইনিংসে ২৯৬ রানে অলআউট হয়ে ইংল্যান্ডকে জয়ের জন্য ২৭৩ রানের টার্গেট দেয় বাংলাদেশ। লক্ষ্যমাত্রা বড় হলেও, সেটি সহজ করে দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের দুই ওপেনার অধিনায়ক অ্যালিস্টার কুক ও বেন ডাকেট। বিনা উইকেটে ১০০ রান তুলে চা-বিরতিতে যায় ইংলিশরা। তখন কুক ৩৯ ও ডাকেট ৫৬ রানে অপরাজিত আছেন।
ইংল্যান্ডের দুই ওপেনারের এমন ব্যাটিং-এ জয়ের স্বপ্ন দেখা ভুলেই গিয়েছিলো বাংলাদেশ। কিন্তু চা-বিরতির পর প্রথম বলেই বাংলাদেশকে স্বপ্ন দেখতে আহ্বান জানান মিরাজ। ডাকেটের উইকেট তুলে নেন মিরাজ। ৫৬ রানেই থেমে যান ডাকেট।
ঠিক ৬ বল পর জো রুটকে নিজের শিকার বানান সাকিব আল হাসান। এতে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে পুরো বাংলাদেশ। সেই আত্মবিশ্বাস যে কতটা ভয়ংকর, তা হাড়ে হাড়ে টের পায় ইংল্যান্ড। ১৩৯ রানের মধ্যে আরও ৪ উইকেট হারিয়ে বসে সফরকারীরা। আসলে মিরাজের কাছে অসহায় আত্মসমর্পন করে ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা। সেই তালিকায় ছিলেন গ্যারি ব্যালেন্স, মঈন আলী, কুক ও জনি বেয়ারস্টো। ব্যালেন্স ৫, মঈন ০, কুক ৫৯ ও বেয়ারস্টো ৩ রানে মিরাজের শিকার হন। সেই সাথে এই ইনিংসেও ৫ উইকেট শিকারের নজির গড়েন মিরাজ।
মিরাজের এমন আঘাতের পর খাদের কিনারায় পড়ে যায় ইংল্যান্ড। সেখান থেকে দলকে টেনে তোলায় চেষ্টা করেছিলেন বেন স্টোকস ও ক্রিস ওকস। কিন্তু সেই চেষ্টাকে বৃথা করে দেন সাকিব। রানের চাকা সচল করার পথে বাধাঁ হয়ে দাঁড়ান তিনি। ২৫ রান করা স্টোকসের উইকেট উপড়ে ফেলেন সাকিব।
স্টোকস্টের বিদায়ের পর বাংলাদেশের জয় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তারপরও ইংল্যান্ডের টেল-এন্ডার নিয়ে ভয় সামান্যতম হলেও ছিলো। কারন দু’ম্যাচেই সফরকারীদের টেল-এন্ডার ভুগিয়েছিলো বাংলাদেশকে। কিন্তু এবার আর সেই সুযোগ দেননি সাকিব ও মিরাজ। আদিল রশিদ ও জাফর আনসারিকে তুলে নিয়ে বাংলাদেশকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌছে দেন সাকিব। রশিদ ও আনসারি শুন্য হাতে ফিরেন।
আর ৪৬তম ওভারের তৃতীয় বলে ইংল্যান্ডের শেষ ব্যাটসম্যানকে লেগ বিফোর ফাঁদে ফেলে বাংলাদেশকে স্মরণীয় জয় এনে দেন আগেই ৫ উইকেট নিশ্চিত করা মিরাজ। আর বাংলাদেশ নেচে উঠে টেস্ট জয়ের আনন্দে। মিরাজ ৭৭ রানে ৬ ও সাকিব ৪৯ রানে ৪ উইকেট নেন।
এর আগে দ্বিতীয় দিনের শেষ বলে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে হারানোর দুঃখ ভুলে নতুনভাবে তৃতীয় দিন শুরুর পণ করে নামেন সাকিব আল হাসান। তার সঙ্গী ছিলেন আগের দিন বাংলাদেশকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া ওপেনার ইমরুল কায়েস। টেস্ট ক্যারিয়ারের চতুর্থ হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ পাওয়া ইমরুল শুরু করেন ৫৯ রান নিয়ে।
সাকিব ও ইমরুলের স্বপ্ন ছিলো বাংলাদেশের স্কোরটা আরও উঁচুতে নিয়ে যাওয়া। সেই স্বপ্নে বাঁধ সাধার চেষ্টায় ছিলেন ইংল্যান্ডের বোলাররা। কিন্তু ফিল্ডারদের একাধিক ভুলে কয়েকবারই জীবন পান ইমরুল ও সাকিব। কিন্তু এসবে ভড়কে না গিয়ে বাংলাদেশের স্কোর ২’শ স্পর্শ করান তারা। কিন্তু ঐ দলীয় স্কোরেই থেমে যান ইমরুল। প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট নেয়া মঈনের শিকার হন ইমরুল। ৯টি চারে ১২০ বলে ৭৮ রান করেন তিনি। এই ইনিংসের মাধ্যমে অষ্টম ব্যাটসম্যান হিসেবে বাংলাদেশের মাটিতে ১হাজার রান পূর্ণও করেন ইমরুল। সাকিবের সাথে জুটিতে ৪৮ রান যোগ করেন তিনি।
ইমরুলকে হারানোর পর অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমকে নিয়ে রান তোলা সচল রেখেছিলেন সাকিব। সতীর্থের রান তোলার ধরণ দেখে শান্ত মেজাজেই ছিলেন মুশি। তবে শান্ত থাকতে পারেননি ইংলিশ লেগ-স্পিনার আদিল রশিদ। কয়েকবার জীবন পেয়েও উইকেটে সেট হয়ে যাওয়া সাকিবকে বোল্ড করে মুশফিকুরের সাথে গড়ে উঠা ৩৮ রানের জুটি ভাঙ্গেন রশিদ। ৬টি বাউন্ডারিতে ৮১ বলে ৪১ রান করেন সাকিব।
সাকিবের বিদায়টা পছন্দ হয়নি মুশফিকুরের। তাই হয়তো আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন তিনি। সাকিবের ফিরে যাবার ৭ বল পর প্যাভিলিয়নে নিজের জায়গা নিশ্চিত করেন মুশি। মিডিয়াম পেসার বেন স্টোকসের বল খোঁচা মেরে স্লিপে প্রতিপক্ষ অধিনায়কের হাতে ক্যাচ দেন মুশফিকুর। ফলে ৯ রানেই থেমে যায় মুশির ইনিংস।
মুশফিকুর যখন বিদায় নেন তখন দলীয় স্কোর ৬ উইকেটে ২৩৮ রান। এ অবস্থায় ক্রিজে থাকা দুই নতুন ব্যাটসম্যানকে সাব্বির রহমান ও শুভাগত হোমকে চেপে ধরার চেষ্টা করে ইংল্যান্ডের বোলাররা। ইংলিশ দলপতি কুকের ফিল্ডিং সাজানোটা আক্রমনাত্মকই ছিলো। তবে প্রতিপক্ষের উপর পাল্টা আক্রমণ চালান সাব্বির ও শুভাগত।
ওভার প্রতি রান তোলার গতি বাড়িয়ে দেন সাব্বির ও শুভাগত। সাড়ে ছয়ের বেশি রান তুলে স্বাচ্ছেন্দ্যেই বাংলাদেশের লিড বাড়াতে থাকেন তারা। তাতে মনে হচ্ছিলো প্রথম সেশনের শেষটা চওড়া হাসি নিয়ে শেষ করবে বাংলাদেশ। কারন ততক্ষণে দলের লিডকে ২৪৪ রানের নিয়ে গেছেন সাব্বির ও শুভাগত।
লাঞ্চের আগে, চা-বিরতির আগে, দিনের শেষ দিকে ও দিনের শুরুতে উইকেট হারানোটা নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের। তাই লাঞ্চে যাওয়ার ঠিক আগের ওভারের তৃতীয় বলে লেগ বিফোর ফাঁেদ পড়ে নিজের ছোট্ট সুন্দর ইনিংসের সমাপ্তি টানের সাব্বির। রশিদের কুইকার-স্ট্রেইট ডেলিভারিতে আউট হবার আগে ৩টি চারে ১৭ বলে ১৫ রান করেন সাব্বির। শুভাগতও অপরাজিত থাকেন ১১ বলে ১৫ রানে। তার ব্যাট থেকেও আসে ৩টি বাউন্ডারি। এই সেশনে ২৯ দশমিক ৩ ওভারে ৪ উইকেটের বিনিময়ে ১১৬ রান যোগ করতে সমর্থ হয় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা।
স্বীকৃত ব্যাটসম্যানদের অনেকেই ফিরে যাওয়ায় লাঞ্চ বিরতির ৩৮ বল পরই নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। ২৯৬ রানে গুটিয়ে ইংল্যান্ডের সামনে ২৭৩ রানের টার্গেট ছুড়ে দেয় টাইগাররা। ২৫ রানে অপরাজিত থাকেন শুভাগত। আর শেষের তিন ব্যাটসম্যান তাইজুল ইসলাম, মেহেদি হাসান মিরাজ ও কামরুল ইসলাম রাব্বির রান ছিলো যথাক্রমে ৫, ২ ও ৭। ইংল্যান্ডের পক্ষে রশিদ ৪টি, স্টোকস ৩টি ও আনসারি ২টি উইকেট নেন।
স্কোর কার্ড (তৃতীয় দিন চা-বিরতি) :
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস : ২২০। (৬৩.৫ ওভার ,তামিম ১০৪, মোমিনুল ৬৬;মঈন ৫/৫৭)।
ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংস : ২৪৪।(৮১.৩ ওভার,রুট ৫৬, ; মিরাজ ৬/৮২)।
বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস (আগের দিন ১৫২/৩ )
তামিম ইকবাল ক কুক ব আনসারি ৪০
ইমরুল কায়েস এলবিডব্লু ব মঈন ৭৮
মোমিনুল হক ক কুক ব স্টোকস ১
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ বোল্ড ব আনসারি ৪৭
সাকিব আল হাসান বোল্ড ব রশিদ ৪১
মুশফিকুর রহিম ক কুক ব স্টোকস ৯
সাব্বির রহমান এলবিডব্লু ব রশিদ ১৫
শুভাগত হোম অপরাজিত ১৫
তাইজুল ইসলাম ক বেয়ারস্টো ব স্টোকস ৫
মেহেদি হাসান মিরাজ ক রুট ব রশিদ ২
কামরুল ইসলাম মিরাজ ক এন্ড ব রশিদ ৭
অতিরিক্ত (বা- ১৭, লে বা- ৭, ও-১, নো-১) ২৬
মোট (অলআউট, ৬৬.৫ ওভার) ২৯৬
উইকেট পতন : ১/৬৫ (তামিম), ২/৬৬ (মোমিনুল), ৩/১৫২ (মাহমুদুল্লাহ), ৪/২০০ (ইমরুল), ৫/২৩৮ (সাকিব), ৬/২৩৮ (মুশফিকুর), ৭/২৬৮ (সাব্বির), ৮/২৭৩ (তাইজুুল), ৯/২৭৬ (মিরাজ), ১০/২৯৬ (রাব্বি)।
বোলিং :
স্টিভেন ফিন ৩-০-১৮-০।
মঈন আলী ১৯-২-৬০-১।
জাফর আনসারি ১৯-০-৭৬-২।
বেন স্টোকস ১২-২-৫২-৩।
আদিল রশিদ ১১.৫-১-৫২-৪।
ক্রিস ওকস ২-০-১৪-০।
ইংল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংস :
অ্যালিষ্টার কুক ক মোমিনুল ব মিরাজ ৫৯
বেন ডাকেট বোল্ড ব মিরাজ ৫৬
জো রুট এলবিডব্লু ব সাকিব ১
গ্যারি ব্যালেন্স ক তামিম ব মিরাজ ৫
মঈন আলী এলবিডব্লু ব মিরাজ ০
বেন স্টোকস বোল্ড ব সাকিব ২৫
জনি বেয়ারস্টো ক শুভাগত ব মিরাজ ৩
ক্রিস ওকস অপরাজিত ৯
আদিল রশিদ এলবিডব্লু ব সাকিব ০
জাফর আনসারি ক ইমরুল ব সাকিব ০
স্টিভেন ফিন এলবিডব্লু ব মিরাজ ০
অতিরিক্ত (বা-৪, লে বা-২) ৬
মোট (অলআউট, ৪৫.৩ ওভার) ১৬৪
উইকেট পতন : ১/১০০ (ডাকেট), ২/১০৫ (রুট), ৩/১২৪ (ব্যালেন্স), ৪/১২৪ (মঈন), ৫/১২৭ (কুক), ৬/১৩৯ (বেয়ারস্টো), ৭/১৬১ (স্টোকস), ৮/১৬১ (রশিদ), ৯/১৬১ (ওকস), ১০/১৬৪ (ফিন)।
বোলিং :
মেহেদি হাসান মিরাজ : ২১.৩-২-৭৭-৬।
সাকিব আল হাসান : ১৩-১-৪৯-৪।
শুভাগত হোম ৬-০-২৫-০।
তাইজুল ইসলাম ৫-২-৭-০।
ফল : বাংলাদেশ ১০৮ রানে জয়ী।
সিরিজ : দুই ম্যাচের সিরিজ ১-১ সমতায় শেষ।
ম্যাচ ও সিরিজ সেরা : মেহেদি হাসান মিরাজ (বাংলাদেশ)।