শেষ তিন ওভারের নাটকীয়তায় আফগানিস্তানকে ৭ রানে হারালো বাংলাদেশ। রোববার মিরপুরের শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বনাম আফগানিস্তান তিন ম্যাচের সিরিজে এই জয়ের ফলে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল টাইগাররা।
টস জিতে প্রথমে ব্যাটিং নেয়া বাংলাদেশ নির্ধারিত ৫০ ওভারে সবকটি উইকেট হারিয়ে ২৬৫ রান সংগ্রহ করে। ওপেনার তামিম ইকবাল স্বাগতিক দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৮০ রান ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ৬২ রান সংগ্রহ করেন। অল রাউন্ডার সাকিব আল হাসান সংগ্রহ করেন ৪৮ রান। আফগানিস্তানের হয়ে সর্বাধিক ৪ উইকেট সংগ্রহ করেন দৌলত জাদরান। দুটি করে উইকেট নেন মোহাম্মদ নবী ও রাশিদ খান।
জবাবে জয়ের জন্য সফরকারী আফগানিস্তান ২৬৬ রানের টার্গেট নিয়ে ব্যাটিংয়ে নেমে অল আউট হয়ে যায় ২৫৮ রানে। দলের হয়ে রহমত শাহ ৭১ ও হাসমতুল্লাহ ৭২ রান সংগ্রহ করেন। স্বাগতিক দলের হয়ে ম্যাচ জেতানো ৪ উইকেট লাভ করেন নির্বাসন থেকে সদ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরা তাসকিন। দুটি করে উইকেট নেন অধিনায়ক মাশরাফি ও তারকা অল রাউন্ডার সাকিব আল হাসান।
প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ইনিংসের শুরুতেই হোঁচট খায় বাংলাদেশ। ইনিংসের পঞ্চম বলেই পুল খেলতে গিয়ে ক্যাচ দেন সৌম্য সরকার (০)। দলীয় ১ রানে সৌম্যর বিদায়টা বিপদের ঘনঘটা বয়ে আনেনি। ব্যাট হাতে নির্ভরতার প্রতীক হয়ে আবির্ভূত হন তামিম ও ইমরুল। তাদের নির্ভেজাল ব্যাটিংয়ে এগিয়েছে বাংলাদেশের ইনিংস। ওয়ানডে দলে আসা-যাওয়ার মাঝে থাকা ইমরুল ব্যাটিং করেছেন পরিস্থিতির দাবি মিটিয়ে। ক্রমশই লম্বা হতে থাকা তামিম-ইমরুলের ৮৩ রানের জুটি বিচ্ছিন্ন হয় ১৯তম ওভারে। নবীর নিচু হয়ে আসা বলটা ইমরুলের ব্যাটে লেগে স্ট্যাম্প ভেঙে দেয়। বিদায়ের আগে ইমরুল করেন ৩৭ রান।
ইনিংসের শুরু থেকেই ধীরস্থির তামিমকেই দেখা যাচ্ছিল ব্যাট হাতে। সঙ্গী সৌম্য, ইমরুলরা ফিরে গেলেও দলকে বড় রানের ভিত গড়ে দেয়ার কাজটাই করছিলেন তামিম। ইনিংসে ১৫ রান করতেই বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিন ফরম্যাটে ৯ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। ক্যারিয়ারের ৩৩তম হাফ সেঞ্চুরি পেয়ে যান ৬৩ বলে। সেঞ্চুরিও প্রায় দৃষ্টিসীমায় ছিল। কিন্তু তার মনোসংযোগে চিড় ধরে ৩৬তম ওভারে। মিরওয়াইস আশরাফের করা ওভারের প্রথম বলে লং অফে ক্যাচ দিলেন তামিম। ইতি ঘটে তামিম-মাহমুদউল্লাহর ৭৯ রানের জুটির।
৯৮ বলে ৯টি চারে ৮০ রান করেছেন তামিম। রয়ে-সয়ে শুরু করা মাহমুদউল্লাহও একটা সময় খোলস ছাড়িয়ে আক্রমণ শুরু করেন। দৌলত জাদরানের ৩৮তম ওভারে দুটি চার ও একটি ছক্কা মারেন তিনি। ১৫তম হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ৬৫ বলে। নবীর শিকার হওয়ার আগে ৭৪ বলে ৬২ রান (৫ চার, ২ ছয়) করেন মাহমুদউল্লাহ। ব্যাটিং অর্ডারে একধাপ অবনমন হওয়া মুশফিক (৬) ও সাব্বির (২) সুবিধা করতে পারেননি। দু’জনই লেগ স্পিনার রশিদ খানের শিকার হন। সতীর্থরা আসা যাওয়ার মাঝে থাকলেও পাঁচ নম্বরে ব্যাটিংয়ে আসা সাকিব খেলে গেছেন স্বরূপে। ২ রানের জন্য হাফ সেঞ্চুরি মিস করেছেন তিনি। ৪৮তম ওভারে বাউন্ডারিতে ধরা পড়েন সাকিব। ৪০ বলে ৪৮ রান করেন তিনি। শেষ দিকে তাইজুলের ১১ রানের ইনিংসে আড়াইশো পার হয় বাংলাদেশের স্কোর। মাশরাফি ৪, তাসকিন ২ ও রুবেল অপরাজিত ১ রান করেন।
জবাবে বাংলাদেশ শিবিরে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল আফগানিস্তান। শেষ অবধি নিজেদের প্রতিরোধটা ধরে রাখতে পারেনি সফরকারীরা। অনেক নাটকীয়তার পর বছরের ও মৌসুমের প্রথম ওয়ানডেতে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে সক্ষম হয় বাংলাদেশ।
তৃতীয় উইকেটে রহমত শাহ ও হাসমতউল্লাহর ১৪৪ রানের জুটি ভাঙার পরই ম্যাচে ফিরে বাংলাদেশ। দলীয় ১৯০ রানে রহমত শাহ আউট হওয়ার পরের ৬৮ রানে শেষ ৭ উইকেট হারায় আফগানরা। শেষ তিন ওভারে তাসকিনের দুর্দান্ত বোলিংয়ে ম্যাচ জিতে মাশরাফি বাহিনী। দুই ওভারে তাসকিন তুলে নেন চার উইকেট। তাতেই জয় নিশ্চিত হয় বাংলাদেশের।
অনাতিক্রম্য না হলেও ২৬৬ রানের টার্গেট সহজ ছিল না আফগানদের জন্য। বোলিং অ্যাকশন শুধরে ফেরা তাসকিনের সঙ্গে বাংলাদেশও হাসতে পারতো ইনিংসের অষ্টম বলেই। স্লিপে শেহজাদের সহজ ক্যাচ ফেলেন ইমরুল। সেই শেহজাদকে ফিরিয়েই আফগানদের ওপেনিং জুটি ভেঙেছেন মাশরাফি সপ্তম ওভারে। মুশফিকের কাছে ক্যাচ দেয়া শেহজাদ ৩১ রান করেন। বোলিংয়ে এসে নিজের তৃতীয় বলেই সাকিব এলবির ফাঁদে ফেলেন সাবির নুরীকে (৯)।
এরপরই তৃতীয় উইকেটে বড়সড় প্রতিরোধ গড়েন রহমত শাহ ও হাসমতউল্লাহ শাহিদি। তাদের দৃঢ়তাপূর্ণ ব্যাটিংয়ে ম্যাচ থেকে প্রায় ছিটকে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। যদিও ৪০তম ওভারে তাইজুলের বলে হাসমতউল্লাহর (তখন তিনি ৬৩ রানে ছিলেন) সহজ ক্যাচ ফেলেছেন মাহমুদউল্লাহ ডিপ মিড উইকেটে। প্রানান্তকর চেষ্টার পর ৪১তম ওভারে উইকেটের দেখা পায় বাংলাদেশ। সাকিবের বলে স্ট্যাম্পড হন রহমত শাহ। ভাঙে ১৪৪ রানের জুটি। রহমত শাহ ৯৩ বলে ৭১ রান (২ চার, ৩ ছয়) করেন।
জীবন পাওয়া হাসমতউল্লাহ ফিরেছেন তাইজুলের বলেই। ৭২ রান করে ৪৪তম ওভারে সৌম্যর হাতে ক্যাচ দেন তিনি। নিজের শেষ ওভারে মাশরাফি ফেরান নাজিবউল্লাহ জাদরানকে (৭)। তবে নবীর আক্রমণাত্মক ব্যাটিং টিকিয়ে রেখেছিল আফগানদের। শেষ ১৮ বলে ২৭ রান দরকার ছিল তাদের। তাসকিনের করা ৪৮তম ওভারেই ম্যাচে ফিরে বাংলাদেশ। তাসকিনের শিকার হন বিপদজ্জক নবী ও আজগর স্তানিকজাই। চতুর্থ বলে সাব্বিরের হাতে ক্যাচ দেন ৩০ রান করা নবী। শেষ বলে আজগর (১০) ধরা পড়েন মাহমুদউল্লাহর হাতে।
৪৯তম ওভারের শেষ বলে রুবেল বোল্ড করেন রশিদ খানকে (৭)। শেষ ৬ বলে ১৩ রান দরকার ছিল আফগানদের। তাসকিনের দ্বিতীয় বলেই মিরওয়াইস আশরাফ (৩) এলবির ফাঁদে পড়েন। শেষ বলে দৌলত জাদরানও (২) সাব্বিরের হাতে ক্যাচ দেন। ফলে ম্যাচ জিতে যায় বাংলাদেশ।
ব্যাট হাতে ৪৮ রানের পর বল হাতে ২ উইকেট শিকার করে ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হন সাকিব।
স্কোর কার্ড:
বাংলাদেশ ব্যাটিং
তামিম ইকবাল ক নবিন উল হক ব মিরওয়াইস আশরাফ ৮০
সৌম্য সরকার ক সাবির নুরি ব দৌলত জাদরান ০
ইমরুল কায়েস বোল্ড মোহাম্মদ নবী ৩৭
মাহমুদুল্লাহ ক মিরওয়াইস আশরাফ ব মোহাম্মদ নবী ৬২
সাকিব আল হাসান ক নাজিবুল্লাহ ব দৌলত ৪৮
মুশফিকুর রহিম বোল্ড রশিদ খান ৬
সাব্বির রহমান এলবিডব্লিউ ব রশিদ খান ২
মাশরাফি মোর্তাজা ক রশিদ খান ব নবীন উল হক ৪
তাইজুল ইসলাম ক রহমত শাহ ব দৌলত ১১
তাসকিন আহমেদ বোল্ড দৌলত ৩
রুবেল হোসেন অপরাজিত ১
অতিরিক্ত (বাই-১, লেবা-১, ও-১০ ১২
মোট (৫০ ওভার, অল আউট) ২৬৫
উইকেট পতন: ১/১ (সৌম), ২/৮৪ (ইমরুল কায়েস), ৩/১৬৩ (তামিম), ৪/২০৩ (মাহমুদুল্লাহ), ৫/২১৫ (মুশফিকুর রহিম), ৬/২২৭ (সাব্বির রহমান), ৭/২৪৬ (সাকিব), ৮/২৫৪ (মাশরাফি), ৯/২৬০ (তাসকিন), ১০/২৬৫ (তাইজুল)
বোলিং: দৌলত জাদরান ১০-০-৭৩-৪ (ও-৪), নবিন উল হক ১০-০-৬২-১ (ও-২) , মোহাম্মদ নবী ১০-০-৪০-২ (ও-১) , মিরওয়াইস আশরাফ ১০-০-৫১-১ (ও-১) , রশিদ খান ১০-০-৩৭-২ (ও-১)।
আফগানিস্তান ব্যাটিং:
সাবির নুরি এলবিডব্লিউ বোল্ড সাকিব আল হাসান ৯
মো. শেহজাদ ক মুশফিকুর ব মাশরাফি ৩১
রহমত শাহ স্ট্যাম্পড মুশফিকুর ব সাকিব ৭১
হাসমাতুল্লা শাহিদি ক সৌম্য ব তাইজুল ৭২
মো. নবী ক সাব্বির ব তাসকিন ৩০
নাজিবুল্লাহ জাদরান ক মুশফিকুর ব মাশরাফি ৭
আজগর স্তানিকজাই ক মাহমুদুল্লাহ ব তাসকিন ১০
রাশিদ খান বোল্ড রুবেল হোসেন ৭
মিরওয়াইস এলবিডব্লিউ ব তাসকিন ৩
দৌলত জাদরান ক সাব্বির ব তাসকিন ২
নবিন উল হক অপরাজিত ০
অতিরিক্ত (বাই-১, লেবা -২, ও-১৩) ১৬
মোট (অলআউট, ৫০ ওভার) ২৫৮
উইকেট পতন: ১/৪৬ (শেহজাদ), ২/৪৬ (নুর), ৩/১৯০(রহমত), ৪/২১০ (হাসমাতুল্লা), ৫/২৩০(নাজিবুল্লাহ), ৬/২৪৩(নবী), ৭/২৪৫(আজগর), ৮/২৫৩(রাশিদ), ৯/২৫৫(মিরওয়াইস), ১০/২৫৮ (দৌলত)।
বোলিং: মাশরাফি ১০-০-৪২-২ (ও-১) , তাসকিন আহমেদ ৮-০-৫৯-৪(ও-৫), সাকিব আল হাসান ১০-০-২৬-২ (ও-২), রুবেল হোসেন ৯-০-৬২-১ (ও-৩), তাইজুল ইসলাম ১০-০-৪৪-১(ও-১) , মাহমুদুল্লাহ ৩-০-২২-০।