যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলবে, এজন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে আমি প্রস্তুত : শেখ হাসিনা

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলবে, এজন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে আমি প্রস্তুত : শেখ হাসিনা

pm.18দেশে যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার অব্যাহত থাকবে বলে দৃঢ় সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য যেকোন ত্যাগ স্বীকারে তিনি সবসময় প্রস্তুত রয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বজন হারাদের ব্যথা আমি বুুঝি। একাত্তরে যারা আপনজন হারিয়েছে তাদের দুঃখ, বেদনা আমি মর্মে উপলদ্ধি করি। তাই যেমন আমার পিতা-মাতা, ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিচার করেছি তেমনি যারা আপনজন হারিয়েছেন তাদের হত্যাকান্ডের বিচারও আমি করে যাচ্ছি এবং করে যাব। যতই বাধা, বিপত্তি প্রতিকূলতা আসুক।’
একে একে যে অন্যায়গুলা হয়েছে সেই অন্যায়গুলোর বিচার তাঁর সরকার করতে পেরেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে যাচ্ছি। যে বিচার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শুরু করে গিয়েছিলেন। কয়েকজনের ইতোমধ্যে রায়ও কার্যকর হয়েছ্, এটা অব্যাহত থাকবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে ফার্মগেটস্থ বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনষ্টিটিউশন মিলনায়তনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের উদ্যোগে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একে একে যে অন্যায়গুলা হয়েছে সেই অন্যায়গুলোর বিচার আমরা করতে পেরেছি। বঙ্গবন্ধু হতাকান্ডের বিচার করেছি । খুনীদের ফাঁসি হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে যাচ্ছি। যে বিচার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শুরু করে গিয়েছিলেন। কয়েক জনের ইতোমধ্যে রায়ও কার্যকর হয়েছে, এটা অব্যাহত থাকবে।’
তিনি এজন্য দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, আমি কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশের জনগণের প্রতি। কারণ বাবা-মা-ভাই সব হারিয়ে একা, নিঃস্ব, রিক্ত, নিঃসঙ্গ হয়ে এদেশের মাটিতে ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু লাখো কোটি মানুষের যে ভালবাসা, যে স্নেহ, যে সাহায্য, আওয়ামী লীগসহ আমাদের প্রতিটি সহযোগী সংগঠন এবং দেশের মানুষ তাদেরই সহযোগিতায় এটা আমরা করতে পেরেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বজন হারাদের ব্যথা আমি বুুঝি। একাত্তরে যারা আপনজন হারিয়েছে তাদের দুঃখ, বেদনা আমি মর্মে উপলদ্ধি করি। তাই যেমন আমার পিতা-মাতা, ভাই, ভাইয়ের হত্যাকারিদের বিচার করেছি তেমনি যারা আপনজন হারিয়েছেন তাদের হত্যাকান্ডের বিচারও আমি করে যাচ্ছি এবং করে যাব। যতই বাধা, বিপত্তি প্রতিকূলতা আসুক।’
তিনি এ সময় বলেন, ‘যদি সংকল্প দৃঢ় থাকে, যেকোন অর্জন সম্ভব। আর বঙ্গবন্ধুই বলেছেন মহৎ অর্জনের জন্য মহান ত্যাগের দরকার। যে কোন ত্যাগ স্বীকারে আমি সব সময় প্রস্তুত, এদেশের জন্য। এদেশের মানুষের জন্য।’
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘কারণ আমি কখনও ভুলতে পারি না এদেশের মানুষের জন্যই তো আমার, বাবা-মা, ভাইয়েরা জীবন দিয়েছেন। কাজেই্ এদেশের মানুষের কল্যাণের জন্য, তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, এই মানুষকে একটু সুন্দর জীবন দেয়ার জন্য যেকোন ত্যাগ স্বীকারে সবসময়ই আমি প্রস্তুত।’
ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো বক্তৃতা করেন সাংবাদিক-গবেষক সৈয়দ বদরুল আহসান। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসেন অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
অনুষ্ঠনের শুরুতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ ১৫ আগষ্টের শহীদদের স্মরণে একমিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, ১৫ই আগস্ট কারা ঘটিয়েছিল, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি। বাংলাশের বিজয়কে মেনে নিতে পারেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা হোক-তারা চায়নি। তাদেরই কিছু দোসর এবং এদেশীয় দালাল এই জঘন্য ঘটনা ঘটায়।
তিনি বলেন, ১৫ আগষ্টের পর থেকে আমরা কি দেখেছি-বাংলাদেশে ইতিহাস বিকৃতি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সব বিজয় ইতিহাসকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলার চেষ্টা। একটা প্রজন্মকে দেশের সঠিক ইতিহাসই জানতে দেয়া হয়নি। ‘৭৫ থেকে ’৯৬ পর্যন্ত ২১ বছর এদেশে জাতির পিতার নাম নিষিদ্ধ ছিল, তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক পর্যন্ত বাজানো যেত না। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজাতে গিয়ে ছাত্রলীগের নেতা চুন্নু জীবন দেয়। এভাবে আওয়ামী লীগের বহুনেতা কর্মী জীবন দিয়ে হলেও প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছে।
বিকৃত ইতিহাস সৃষ্টির অপচেষ্টা থেকেই দেশে সামাজিক ব্যাধি জঙ্গিবাদের সৃষ্টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা জাতি যদি বিকৃত ইতিহাস শুনতে থাকে তাহলে কিন্তু তাদের চরিত্রও বিকৃত হয়ে যায়। সেই বিকৃতি কিন্তু এখন আমরা সমাজে দেখি । যেখান থেকে জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসের উত্থান ঘটে। যা আজকে সমাজকে কুরে খাচ্ছে।’

জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়া ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে বঙ্গবন্ধুর বিচারের পথ রুদ্ধ করার পাশাপাশি খুনীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃতই শুধু করেননিÑ লন্ডন থেকে সেখানকার পার্লামেন্ট সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটি তদন্ত কমিশনকে সে সময়ে বাংলাদেশে আসতেও বাধা প্রদান করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা লন্ডনে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছিলেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদসদের নিয়ে এই কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের প্রধান ছিলেন নোবেল বিজয়ী শ্যন ম্যাক ব্রাইট এবং তার সঙ্গে ছিলেন স্যার টমাস উইলিয়াম কিউসি এমপি। এই কমিশনের পক্ষ থেকে স্যার টমাস উইলিয়ামকে নির্বাচিত করা হয়। তিনি বাংলাদেশে আসবেন বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্ত করতে। কিন্তু জিয়াউর রহমান তাকে এ দেশে আসার ভিসা দেননি। …এই হত্যার সঙ্গে সে (জিয়াউর রহমান) জড়িত ছিল তাতে কোন সন্দেহ নাই। এ ঘটনায় সেটাই প্রমাণিত হয়Ñ যা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘খুনীরা দর্পভরে এ সময় বলতোÑ কে তাদের (বঙ্গবন্ধুর খুনীদের) বিচার করবে। তার বিচার করেছি। আমরা করেছি।’
প্রধানমন্ত্রী পঁচাত্তর পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর খুনী ও যুদ্ধাপরাধীদের দেশে পুনর্বাসনকারী হিসেবে জিয়াউর রহমানকে অভিযুক্ত করে বলেন, ‘একদল দাবি করে (বিএনপি) তারা দেশে গণতন্ত্র দিয়েছে। আসলে গণতন্ত্র না- তারা কারফিউ গণতন্ত্র দিয়েছিল।’
’৭৫-এর পর থেকে ’৮৬ সাল পর্যন্ত প্রতিরাতেই দেশে কারফিউ বলবৎ ছিলো। সাধারণ মানুষের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকারটুকু পর্যন্ত ছিলো না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকেই প্রবাস জীবন কাটাতে বাধ্য হওয়া শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দেশে ফেরার স্মৃতিচারণ করে বলেন, যখন বাংলার মাটিতে ফিরেছিলাম তখন এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই এসেছিলাম যে, এই হত্যার (বঙ্গবন্ধু হত্যার) বিচার বাংলার মাটিতে করবো। আর মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনাকে ফিরিয়ে আনবো, যে চেতনায় একদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। সেই চেতনাতেই আবার আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলবো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি চাই বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। আজকে যে সম্মানজনক অবস্থানে বাংলাদেশ এসেছে, সেখানে পৌঁছতে বার বার আঘাত এসেছে। কিন্তু সেখান থেকে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যেন দেশকে গড়ে তোলার পথে আমরা আবারো দেশকে নিয়ে যাচ্ছি।
এ ক্ষেত্রে ছাত্র সমাজের বিরাট ভূমিকা রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। আমাদের গৌরবের ইতিহাস, বিজয়ের ইতিহাস আমরা কখনও ভুলবো না, ভুললে আমাদের অস্তিত্বই থাকবে না। ওই আলবাদর, রাজাকারদের হাতের ক্রীড়নক হয়ে আমরা থাকতে পারি না। কারণ, তারা আমাদের দেশের স্বাধীনতাই চায়নি।
দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রলীগের অবদানের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ছাত্রলীগের ঐতিহ্য রয়েছে এ দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে।’
শেখ হাসিনা বলেন, আমি ছাত্রলীগকে একটা কথাই বলবো, ছাত্ররা লেখাপড়া শিখবে, উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলবে। তাই আমরা ছাত্রদের হাতে কাগজ-কলম তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু ’৭৫-এর পর আমরা দেখি জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে ছাত্রদের হাতে তুলে দিয়েছিল অস্ত্র। অবৈধ অর্থ অর্জনের পথ দেখিয়েছিল। তাদের একটি বিকৃতির পথে নিয়ে গিয়েছিল। কারণ, এই ছাত্র সমাজকে তারা ধ্বংস করতে চেয়েছিল। তারা জানত যে, এই ছাত্র সমাজই বাঙালির প্রতিটি অর্জনের পেছনে সবসময় একটি ভূমিকা রেখেছে। কাজেই এই ছাত্র সমাজের চরিত্র হনন করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য।
ছাত্রদের মূল কাজ লেখাপড়া হলেও তারা রাজনীতিও করবে এবং তারা রাজনীতি করেই একটা সময় তারা এ দেশের মূল চেতনাকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা স্বাধীনতা অর্জনে বড় ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এখন আমরা স্বাধীন জাতি। আমাদের এই দেশকে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য লেখাপড়া করে নিজেদের আগামীর নেতৃত্ব প্রদানে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী তাঁর মায়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন, বাবার কথা তো অনেক লেখা হয়, মায়ের কথা তো লেখা হয় না। তবে আমার মায়ের অবদান কিন্তু কম নয়। তিনি বাবার পাশে থেকে অনেক কাজ করে গেছেন। সেসবও তুলে আনা দরকার।
তিনি বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বলেন, ‘ঘাতকরা মনে হয় মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলার সকল আন্দোলন-সংগামে আমার মায়ের ভূমিকার কথা জানতো। তাই তাঁকেও রেহাই দেয়নি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে লক্ষ-কোটি বাঙালির বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে রেসকোর্স ময়দানে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তাতে একটি রাষ্ট্র পরিচালনার সবরকমের দিকনির্দেশনা ছিলো। মাত্র সাড়ে ৩ বছরে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা নজিরবিহীন। এখনও কাজ করতে গেলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সে সময়কার গৃহীত পদক্ষেপের প্রতিফলন দেখতে পেয়ে বিস্মিত হতে হয় বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা একজন রাজনীতিকের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সামনে রেখেই ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য সকলকে একযোগে কাজ করে যাবারও আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি সবাইকে পড়ে দেখার আহ্বান জানান এবং আগামীতে বঙ্গবন্ধুর ডায়েরিও সকলের হাতে তুলে দিতে পারবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

অন্যান্য আইন আদালত বাংলাদেশ শীর্ষ খবর