সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় পার্টির (জাপা) শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের একের পর এক ভারত সফর নিয়ে ঔৎসুক্যের সৃষ্টি হয়েছে দলে। এ নিয়ে বাইরেও আলোচনা আছে।
জাপার উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, দেশে ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের আকস্মিক উত্থান এবং দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে এ সফরগুলো তাৎপর্যপূর্ণ। আগামী সংসদ নির্বাচনের সঙ্গেও এর যোগসূত্র আছে।
এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাপার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জিয়াউদ্দিন আহমেদ ১ আগস্ট রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে ভারত সফরে যান। দলীয় সাত সাংসদের একটি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন তিনি। এরশাদের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণার পরও জাপাকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নিতে তাঁর ভূমিকা ছিল। এর আগে ১৮ জুন ভারতে যান দলীয় প্রধান এরশাদ। চার দিনের ওই সফরে এরশাদ দেশটির জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
কথা বলে জানা গেছে, জাপার সাংসদেরা এই সফরে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব, কংগ্রেসের সহসভাপতি রাহুল গান্ধী, সাবেক সেনাপ্রধান ও বিবেকানন্দ ফাউন্ডেশনের পরিচালক জেনারেল (অব.) নির্মল চন্দ্র ভিজ, লোকসভার ডেপুটি স্পিকার, রাজ্যসভার ভাইস চেয়ারম্যানসহ আরও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ ছাড়া প্রতিনিধিদলটি দেশটির গবেষণা সংস্থা বিবেকানন্দ ফাউন্ডেশন, অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ) এবং ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে একাধিক সেমিনারেও অংশ নেয়।
প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন জাপার সাংসদ ফখরুল ইমাম, আলতাফ আলী, পীর ফজলুর রহমান, নুরুল ইসলাম, আমির হোসেন ভূঁইয়া ও মোহাম্মদ নোমান।
জাপার মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার এ সফরকে ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে জাতীয় পার্টি এবং উভয় দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়। এ ধরনের যোগাযোগ ও সম্পর্কের অগ্রগতি থাকার যথেষ্ট প্রয়োজন আছে।’
তবে ভারত সফরকারী প্রতিনিধিদলটির একাধিক সদস্য বলেন, গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সেমিনার ও ব্যক্তিগত আলোচনায় বাংলাদেশ ও ভারতের নিরাপত্তা এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করার কৌশলগত দিকগুলো প্রাধান্য পায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পাশাপাশি আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গও আলোচনায় আসে। কারও কারও কথায় নির্বাচন নিয়ে নিজেদের ভাবনার কিছু দিকও প্রকাশ পায়।
প্রতিনিধিদলের প্রধান জিয়াউদ্দিন আহমেদ এই সফরকে ‘ফলপ্রসূ’ দাবি করে প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের সরকার ও ক্ষমতাসীন দল, কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় অনেক বিষয়ে কথা হয়েছে। আলোচনায় মনে হয়েছে, তাঁরা বাংলাদেশের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক সরকার অব্যাহত থাকুক, তা দেখতে চান।
জাপার প্রতিনিধিদলের একটি সূত্র জানায়, ভারতের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা গুলশান হামলা এবং তারও আগে একের পর এক হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে সংখ্যালঘুদের জায়গা-জমি দখল করাসহ তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথাও জানান। সেখানকার একটি সংস্থার উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের নিগ্রহের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেন বলেও ওই সূত্র দাবি করে।
জানতে চাইলে সফরকে ‘চমৎকার’ বলে মন্তব্য করেন সফরকারী জাপার সাংসদ ও বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব ফখরুল ইমাম। তিনি বলেন, সেমিনারে ভারতের থিংক ট্যাঙ্কগুলোকে (গবেষণা সংস্থা) বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল মনে হয়েছে।
তবে অনেক ক্ষেত্রে ভুল তথ্যও ছিল উল্লেখ করে ফখরুল ইমাম বলেন, ‘ওনারা বলেছেন, স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ৩১ ভাগ, যা এখন ৫ ভাগে নেমে এসেছে। আমরা বলেছি, এ তথ্য ঠিক নয়। ওই সময় হিন্দু সম্প্রদায় ছিল ২১ ভাগ, এখন ১১ ভাগ।’
ফখরুল ইমাম গতকাল মঙ্গলবার এ প্রতিবেদককে বলেন, তাঁর নেতৃত্বেই জাপার প্রতিনিধিদল ভারত সফর করেছে। দলের পক্ষ থেকে এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষও তাঁকে দলনেতা হিসেবে চিঠি দিয়েছে।
জাপার উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র বলেছে, দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ের আলোচনায় প্রভাবশালী দেশটি আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দেখার আগ্রহের কথা জানায়। যদিও এ নিয়ে জাপার শীর্ষ নেতৃত্ব কিছুটা সন্দিহান।
ওই দেশটির মনোভাবের বিষয়ে নিজের সংশয়ের কথা জানিয়ে জাপার একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এবং আগামী সংসদে জাপাকে তারা সত্যিকার অর্থে কোন অবস্থানে দেখতে চায়, তা পরিষ্কার নয়। কারণ, জাপার সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার পাশাপাশি আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নতুন একটি দল গড়ার তৎপরতাও লক্ষ করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নেতা বলেন, প্রভাবশালী দেশটির কোনো সংস্থার সায় নিয়েই মাঝে কিছুদিন সরকারবিরোধী কথাবার্তা বলে মাঠে সক্রিয় হয়েছিল জাপা। এ বছরের শুরুতে এরশাদ যে নিজের ছোট ভাই জি এম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান নিয়োগ এবং জিয়াউদ্দিনকে সরিয়ে রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব করেন, সেটিও ছিল বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। এ ছাড়া এরশাদ মন্ত্রিসভায় থাকা দলের তিন সাংসদ আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক ও মশিউর রহমানকে ছাড়িয়ে আনতে যে তৎপরতা দেখান, তাতেও একরকম সায় ছিল। কিন্তু সব তৎপরতাই এখন থেমে গেছে। দলটি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও নেই।