আজ শোকাবহ ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। ইতিহাসের বেদনাবিধুর ও বিভীষিকাময় এক দিন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪১তম শাহাদাতবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের এইদিন অতিপ্রত্যুষে ঘটেছিল ইতিহাসের সেই কলঙ্কজনক ঘটনা। সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল ও বিপথগামী সৈনিকের হাতে সপরিবারে প্রাণ দিয়েছিলেন বাঙালির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই নৃশংস হামলার ঘটনায় আরো যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন তারা হলেন : বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, ভাই শেখ নাসের ও কর্নেল জামিল, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, শিশু বাবু, আরিফ রিন্টু খানসহ অনেকে। আগস্ট মাসটি তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে শোকের মাসে পরিণত হয়েছে।
ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাসভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেও সেদিন আল্লাহর অসীম কৃপায় দেশে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। সে সময় স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে জার্মানিতে সন্তানসহ অবস্থান করছিলেন শেখ হাসিনা। শেখ রেহানাও ছিলেন বড় বোনের সঙ্গে।
বাংলাদেশ ও বাঙালির সবচেয়ে হদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী শোকের দিন আজ। প্রতিবছর ১৫ আগস্ট আসে বাঙালির হূদয়ে শোক আর কষ্টের দীর্ঘশ্বাস হয়ে। বাঙালি জাতি আজ গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে স্মরণ করবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যে আজ পালিত হবে জাতির পিতার শাহাদাতবার্ষিকী। দিবসটি উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ প্রমুখ।
সেদিন যা ঘটেছিল :১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অতিপ্রত্যুষে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে কাপুরুষোচিত আক্রমণ চালায় ঘাতক দল। সে নারকীয় হামলার পর দেখা গেছে, ভবনটির প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ। তাঁর তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। পাশেই পড়ে ছিল তাঁর ভাঙা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল, মূল বেডরুমের সামনে বেগম মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, নীচতলার সিঁড়িসংলগ্ন বাথরুমে শেখ নাসের এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবির ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের লাশ। লুঙ্গিতে জড়ানো শিশু রাসেলের রক্তভেজা লাশ দেখে খুনিদের প্রতি চরম ঘৃণা-ধিক্কার জানানোর ভাষা খুঁজে পান না মানবতাবাদী বিশ্বের কোনো মানুষ। এভাবেই নারকীয় পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
স্বাধীন দেশে কোনো বাঙালি তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে না—এমন দৃঢ়বিশ্বাস ছিল বঙ্গবন্ধুর। সেজন্যই সরকারি বাসভবনের পরিবর্তে তিনি থাকতেন তাঁর প্রিয় ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর ধানমন্ডির অপরিসর নিজ বাসভবনেই। বাঙালির স্বাধিকার-স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার এ বাড়িটি অসম্ভব প্রিয় ছিল বঙ্গবন্ধুর। এখানে থেকেই বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। সেদিন ঘাতকদের মেশিনগানের মুখেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন অকুতোভয়। প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি নাম, একটি ইতিহাস। তার জীবন ছিল সংগ্রামমুখর। সংগ্রামের মধ্যেই তিনি বড় হয়েছিলেন। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তত্কালীন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছাত্র অবস্থায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন সংগ্রামী নেতা। শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ ৬ দফার প্রণেতাও ছিলেন। ৭০’র নির্বাচনে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে এদেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত করেন।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলে ষাটের দশক থেকেই তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়কে পরিণত হন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উত্তাল সমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বজ্রদৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ঘোষণায় উদ্দীপ্ত, উজ্জীবিত জাতি স্বাধীনতার মূলমন্ত্র পাঠ করে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছিনিয়ে আনে দেশের স্বাধীনতা। জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পুরুষ বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি এই স্বাধীন বাংলাদেশ।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক : জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ তার বাণীতে জাতীয় শোক দিবসে জাতির পিতাকে হারানোর শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গঠনে আত্মনিয়োগে সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, এ দেশের মাটিতে কোনো জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের ঠাঁই হবে না। জঙ্গিবাদকে সমূলে উপড়ে ফেলে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা হবে।
কর্মসূচি: আজ সরকারি ছুটির দিন। সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ভবন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে আজ। বিদেশস্থ বাংলাদেশ মিশনসমূহেও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত ও আলোচনাসভার আয়োজন করা হবে। দিনের শুরুতে সকাল সাড়ে ৬টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে দেশ ও জাতির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় কোরআন তেলাওয়াত ও বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। সকাল সাড়ে ৭টায় প্রধানমন্ত্রী বনানী কবরস্থানে গিয়ে শহীদ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্য ও অন্য শহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ করবেন। পরে প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারযোগে টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধুর মাজারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন। সেখানে ফাতেহা পাঠ, বিশেষ মোনাজাত এবং দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এ দুটি স্থানেই তিন বাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল বঙ্গবন্ধুর প্রতি ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করবে।
বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন শোক দিবসের অনুষ্ঠানসমূহ সরাসরি সমপ্রচারসহ বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার এবং সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। সচিত্র বাংলাদেশ এর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ ও বিতরণ এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হবে। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্ব স্ব কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে।
দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগ ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: আজ সূর্য উদয়ক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন এবং আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সংগঠনের সকল কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ এবং কালো পতাকা উত্তোলন, সকাল সাড়ে ছয়টায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং মোনাজাত, ৬টা ৪০ মিনিটে শোক মিছিলসহ বঙ্গবন্ধু ভবনের সম্মুখে আগমন এবং শ্রদ্ধা নিবেদন, সাড়ে ৭টায় বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, সকাল ১০টায় টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, মোনাজাত, মিলাদ ও বিশেষ দোয়া মাহফিল।
বাদ আছর দেশের সর্বত্র মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। সকল মন্দির, গীর্জা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রার্থনা করা হবে। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আলোচনা সভা, জাতীয় শোক দিবসের সঙ্গে তাত্পর্যপূর্ণ কবিতা পাঠ, রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, হামদ্ ও নাত প্রতিযোগিতা ও দোয়ার আয়োজন করবে।
এছাড়া বাংলাদেশ বার কাউন্সিল, বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদ পরিষদ, সুইড বাংলাদেশসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা জানাবে। মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বেলা ১১টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হবে।
এদিকে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভা আগামীকাল মঙ্গলবার বিকাল ৪টায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।