বঙ্গবন্ধু এবং ৩০ লাখ শহীদের ঋণশোধে সরকারি কর্মচারিদের আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে আহবান জানালেন প্রধানমন্ত্রী

বঙ্গবন্ধু এবং ৩০ লাখ শহীদের ঋণশোধে সরকারি কর্মচারিদের আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে আহবান জানালেন প্রধানমন্ত্রী

pm.11ঢাকা, ১০ আগস্ট, ২০১৬: সরকারি কর্মচারিদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার মাধ্যমেই তাঁর এবং ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী সরকারি কর্মচারিদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমরা জনগণের সেবক, জনগণের সেবা করবো। জনগণের রক্ত ঘামঝড়া অর্থ দিয়েইতো আমাদের বেতন-ভাতা, আমাদের সবকিছু। এই কথাটা এক মুহূর্তের জন্যও যেন আমরা ভুলে না যাই।’
জনগণের সেবা করার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মানুষের সেবার মতো শান্তি দুনিয়ায় আর কিছুতে নেই। কোনো দিন গরিব-দুঃখীর ওপর অত্যাচার করবেন না।’
প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪১তম শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রলালয়ের সহযোগিতায় বাংলাদেশ সচিবালয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি সম্পর্কে বলেন, ‘এ উদ্যোগের মতো মহৎ আর কিছু হতে পারে না। জাতির পিতা আমাদেরকে রক্তঋণে আবদ্ধ করে গেছেন, লাখো শহীদ আমাদের রক্তঋণে আবদ্ধ করেছেন। তাদের রক্তের ঋণ আমাদেরকে শোধ করতে হবে। .. আপনারাও রক্ত দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচান, মানুষের পাশে দাঁড়ান।’
অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. শফিউল আলম মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এদেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে গিয়েই জাতির পিতা জীবন দিয়ে গেছেন। এই ওয়াদা তিনি ৭ই মার্চের ভাষনসহ বহু জায়গায় করেছেন এবং জীবন দিয়ে রক্ত দিয়ে সেই ওয়াদাই তিনি পালন করে গেছেন।
তিনি সচিবালয়ের কর্মচারিদের উদ্দেশ্যে বলেন, আজ আপনারা একটি মহৎ কাজ করতে যাচ্ছেন-রক্তদান। একজন রক্ত দেবেন আর একটি মানুষের জীবন বাঁচাবেন।
রক্ত দিলে কোন ক্ষতি না হয়ে শরীরের জন্য উপকার উল্লেখ করে বলেন, নিয়মিত রক্ত দিলে শরীরে নতুন রক্ত কণিতা জন্মে এবং শরীর ভাল থাকে।
প্রধানমন্ত্রী নিজেও ৫৬-৫৭ বছর বয়স পর্যন্ত নিয়মিত রক্ত দিতেন উল্লেখ করে বলেন, তিনি দেশে ফেরার পর থেকে ১৫ আগস্ট উপলক্ষে প্রতিবছর আয়েজিত রক্তদান কর্মসূচিতে নিজেও রক্ত দিয়েছেন।
এখন বয়স হয়ে যাওয়ায় ইচ্ছে থাকলেও আর দিতে পারেন না বলেও উল্লেখ করে বলেন, রক্ত দেয়ার যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে আমি এখনও রক্ত দিতে প্রস্তুত।
প্রধানমন্ত্রী সরকারি কর্মচারিদের উদ্দেশ্যে বলেন, যেকোন কাজ আমরা হাতে নেই না কেন তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব আপনাদের ওপর অনেকাংশে বর্তায়। কাজেই আপনারা আন্তরিকতার সাথে সেই কাজ সম্পাদন করবেন। মানুষের সেবা করুন, মানুষের সেবার মতো শান্তি দুনিয়ায় আর কিছুতে নেই। কোনো দিন গরিব-দুঃখীর ওপর অত্যাচার করবেন না।’
প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার একটি ভাষণের উদ্ধৃতি দেন ‘সরকারের সমস্ত সরকারি কর্মচারিকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য, যাদের অর্র্থে আজকে আমরা চলছি তাদের যেন কষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। যারা অন্যায় করবে আপনারা তাদের অবশ্যই কাঠোর হস্তে দমন করবেন। কিন্তু সাবধান, একটি নিরাপরাধ লোকের ওপরও যেন অত্যাচার না হয় তাতে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। আপনারা সেইদিকে খেয়াল রাখবেন। আপনারা যদি অত্যাচার করেন তাহলে সে পর্যন্ত আমাকেও সেজন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে কারণ আমি আপনাদের জাতির পিতা আমি আপনাদের প্রধানমন্ত্রী আমি আপনাদের নেতা। আমারও সেখানে দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের প্রত্যেকটি কাজের দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত আমার ঘাড়ে চাপে, আমার সহকর্মীদের ঘাড়ে চাপে। এজন্য আপনাদের কাছে আমার আবেদন রইল, আমার অনুরোধ রইল, আমার আদেশ রইল- আপনারা মানুষের সেবা করুন। মানুষের সেবার মত শান্তি দুনিয়ায় আর কিছুতে নাই, আর কিছুতে হয় না। একটা গরীব যদি হাত তুলে দোয়া করে আল্লাহ সেটা কবুল করে নেন। এজন্য কোনদিন কোন গরীব দুঃখির ওপর অত্যাচার যেন হয়, যদি হয় তাহলে আমাদের স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার এই মহামূল্যবান কথাগুলো আমি মনে করি আমরা যারা দায়িত্বে আছি সকলেরই এই কথাগুলি মনে রাখা উচিত।
‘সরকার গঠনের সময় বলেছি, আমরা জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করব। আমাদের চেষ্টা মানুষের কল্যাণে কাজ করা, দেশের উন্নয়নে কাজ করা।’উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা জনগণের সেবক জনগণের সেবা করবো। জনগণের রক্ত ঘাম ঝড়া অর্থ দিয়েইতো আমাদের বেতন-ভাতা, আমাদের সবকিছু। এই কথাটা এক মুহূর্তের জন্যও যেন আমরা ভুলে না যাই।
তিনি বলেন, একাত্তরের আগে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে বাঙালির কোনো অধিকার ছিলো না। বঙ্গবন্ধু সব সময় বাঙালির অধিকার আদায়ের কথা বলেছেন। সে কারণে তাকে নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়েছে, তাঁকে ফাঁসি পর্যন্ত দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল। রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেয়ার পরও তিনি সব সময় ন্যায্য অধিকারের কথা বলেছেন।
১৯৫৬ সালের ৯ জানুয়ারি পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় কর্মক্ষেত্রে পূর্ববাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জাতিগত বৈষম্যের যে চিত্র উপস্থাপিত হয় তা প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে তুলে ধরে বলেন- সে সময় পাকিস্তান সরকারে সচিবদের পদ ছিল ২২টি। যার সবকটির পদাধিকারি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানীরা। যুগ্ম সচিব পদে পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ৪২ জন এবং বাঙালিদের ৮ জন। উপসচিব ৬৯টি পদে আসীন ছিল পশ্চিম পাতিস্তানীরা অন্যদিকে ২৩ জন ছিলেন বাঙালি। সেকশন অফিসার- পশ্চিম পাকিস্তানীরা ছিল ৩২৫ জন আর বাঙালিরা ৫০ জন। প্রথম শ্রেনীর গেজেটেড অফিসার-পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ৩৭৬৯ জন এবং বাঙালি ৮১১ জন। সিনিয়র গেজেটেড অফিসার-পশ্চিম পাকিস্তানী ৬৯২ জন আর বাঙালি ৪২ জন।
সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে বৈষম্য ছিল আরও ভয়াবহ ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩টি জেনারেল পদ, ২০টি মেজর জেনারেলের পদ এবং ৩৪টি ব্রিগেডিয়ারের পদের সবকটিতেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা আসীন ছিলেন। কর্নেল পদে- পশ্চিম পাকিস্তানী ছিল ৪৯ জন এবং বাঙালি মাত্র একজন। লে. কর্নেল পদে- পশ্চিম পাকিস্তানী ১৯৮ জন আর বাঙালি ২ জন। মেজর পদে- পশ্চিম পাকিস্তানী ৫৯০ জন আর বাঙালি ছিলেন ১০ জন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নৌবাহিনীর ৬শ’ পদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানী ৫৯৩ জন এবং বাঙালি ছিলেন ৭ জন। অন্যদিকে বিমানবাহিনীর ৬৪০টি পদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা ৬শ’ পদে আর বাঙালিরা ৪০টি পদে আসীন ছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছিলেন। যুদ্ধজয়ের পর মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারতের সৈন্য ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ সময় তিনি বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে সম্মিলিত যুদ্ধজয়ের পর মিত্রবাহিনী দেশে থেকে যাওয়ার নজীর উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শুধু স্বাধীনতা এনেই দেননি। মানুষের মুক্তির জন্য ব্যাপক কর্মসূচিও হাতে নিয়েছেন। যুদ্ধের পর এ দেশে রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট ছিলো না। ছিল না অবকাঠামোগত কিছুই। জাতির পিতা সেই বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছেন। আমাদেরকে একটি সংবিধান দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য করে গেছেন বাংলাদেশকে।
প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেন, যেসব আন্তর্জাতিক শক্তি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলো, পরে তাদের ষড়যন্ত্রেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। আমার মা ফজিলাতুন নেছা, আমার ভাই শেখ কামাল, জামাল, ছোট্ট রাসেলকেও তারা হত্যা করেছিলো।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী জিয়াউর রহমানের ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরী দিয়ে পুরস্কৃত করা এবং দেশের কারাগারে আটক বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে তাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের তীব্র সমালোচনা করেন।
পচাত্তরের ১৫ আগষ্টের বিয়োগান্তক অধ্যায়ের স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী সরকারি কর্মচারিদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমাদের এই কষ্ট, দুঃখ, ব্যথা-বেদনা ভুলেও দেশের জন্য, মানুষের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করার যে চেষ্টা করে যাচ্ছি- এখানে আপনাদের সহযোগিতা সবসময় কামনা করি। দেশের সেবা করা যেকোন সরকারি কর্মচারিদের একান্তভাবে দায়িত্ব।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় তাঁর সরকারের শাসনামলে দেশের আর্র্থসামাজিক উন্নয়নের খন্ড চিত্র তুল ধরে বলেন, আমরা বিজয়ী জাতি, বিজয়ী জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে যেন মাথা উঁচু করে চলতে পারি, সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
উদ্বোধনী পর্ব শেষে প্রধানমন্ত্রী রক্তদান কর্মসূচি ঘুরে দেখেন এবং স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।
স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে জাতির পিতার রক্তঋণের কিছুটা হলেও দায় শোধের এই মানসিকতা থেকে এদিন স্বেচ্ছায় রক্তদানের জন্য সচিবালয়ের ৪২২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারি তালিকাভুক্ত হন।

অন্যান্য বাংলাদেশ রাজনীতি শীর্ষ খবর