ঢাকা, ৩ আগস্ট ২০১৬ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসলাম ধর্মকে কলুষিত করার অপচেষ্টাকারী মানুষ হন্তারক সন্ত্রাসি-জঙ্গিবাদিদের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানিয়ে বলেছেন, এরাই শান্তিপূর্ণভাবে ধর্ম পালনকারীদের পৃথিবীতে বসবাস কঠিন করে দিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা বিপথে যেয়ে খুন-খারাপি করে, মানুষ হত্যা করে আমাদের পবিত্র ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করছে তাদের বিরুদ্ধে সমগ্র জাতিকে সোচ্চার হতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘তারা মানুষ খুন করে কি অর্জন করছে জানি না। কিন্তু আমরা যারা ধর্মটাকে পালন করি তাদের জন্য এই পৃথিবীতে বসবাস করাটা কঠিন করে দিচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে উত্তরার আশকোনা হাজি ক্যাম্পে ‘হজ কার্যক্রম-২০১৬’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী জঙ্গিবাদ সম্পর্কে বলেন, বাবা-মা, অভিভাবক, শিক্ষক থেকে শুরু করে সকলকে যার যার কর্মস্থলে সজাগ থাকার আমি আহবান জানাচ্ছি। যেন আর কেউ এই বিপথে যেতে না পারে। বাংলাদেশ একটা শান্তিপূর্ণ দেশ। এখানে জঙ্গি-সন্ত্রাসের কোন ঠাঁই হবে না। আর ইসলাম ধর্মও সে অনুমতি দেয় না।
ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন-বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বজলুল হক হারুন এমপি, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্থানীয় এমপি অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এবং বাংলাদেশে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত আব্দুল্লাহ এইচ এম আল মুতাইয়িরি। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব মো.আব্দুল জলিল অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।
ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, এ বছর প্রায় ১,০১,৭৫৮ জন হজযাত্রী বাংলাদেশ থেকে এবারের পবিত্র হজ্জে অংশগ্রহণ করবেন।
এরমধ্যে ৫২০০ জন হজযাত্রী সরকারি ব্যবস্থাপনায় এবং ৯৬,৫৫৮ জন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ্জ আদায় করবেন।
শেখ হাসিনা বলেন, একটি কথা আমি এখানে বিশেষভাবে বলব- ইসলাম শান্তির ধর্ম। এখানে সন্ত্রাসের কোন স্থান নাই । আল্লাহর বানী, আমাদের নবী করিম (সা:) এর বানী- সবখানেই এই কথা স্পষ্ট বলা আছে।
তিনি বলেন, যখন আমি দেখি কিছু বিপথগামী ঠান্ডা মাথায় নিরীহ মানুষ হত্যা করছে তারা মোটেও কোন ভাল কাজ করছে না । বরং ইসলাম ধর্মকে অন্যের কাছে হেয় করে দিচ্ছে । এ ধর্ম সম্পর্কে মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করছে, ধর্মের বদনাম করাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি সব সময় এটাই চাই আমাদের শান্তির ধর্ম ইসলামের মর্যাদা যেন সবসময় সমুন্নত থাকে । পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্ম যেন সবসময় তাঁর স্থান করে নিতে পারে সেটাই সবসময় আমার কামনা।
প্রধামন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় পচাত্তরের ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক অধ্যায় স্মরণ করে বলেন, আগস্ট মাস শোকের মাস। এই মাসেই আমি মা-বাবা ভাই, ভাইয়ের অন্তস্বত্তা স্ত্রী’সহ পরিবারের সকল সদস্যকে হারিয়েছি। বিদেশে ছিলাম বলে আমি ও আমার ছোট বোন শেখ রেহানা বেঁচে যাই।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন বলেই আজ আমাদের দেশ থেকে ১০১৭৫৮ জন হজ যাত্রী হজে যেতে পারছেন। স্বাধীনতার পর পরই দেশ থেকে যেন সবাই হজে যেতে পারেন সেই উদ্যোগ গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। হিজবুল বাহার নামে একটি জাহাজও ক্রয় করেন। তাঁর নেতৃত্বেই আমরা ওআইসি’র সদস্য পদ লাভ করি । তিনি দেশে ঘোরদৌড়, জুয়া, মদ -এগুলো নিষিদ্ধ করেন এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তখনই তৈরি হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু ইসলাম ধর্মকে একবারে তৃণমূল পর্যায়ে প্রচারের জন্য ইসলামি ফাউন্ডেশন ও মাদ্রাসা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন এবং জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের জন্য জমি দিয়ে যান। বিশ্ব ইজতেমার জায়গা, কাকরাইল মসজিদের জন্যও জায়গা দিয়ে যান এবং রেডিও টিভিতে সম্প্রচার শুরুর আগে কোরআন তেলাওয়াতের ব্যবস্থা করেন। ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম, সৌহার্দ্যের ধর্ম -সেই ধর্মের মূল বাণীটা যেন দেশবাসী জানতে পারে জাতির পিতা তাঁর উদ্যোগে সেই ব্যবস্থা করে যান।
তিনি বলেন, জাতির পিতার পদাংক অনুসরণ করেই আমরা সকল ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অফিসগুলো জাতীয় রাজস্ব খাতে এনে দেই এবং সৌদি সহযোগিতায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সম্প্রসারণ ও শ্রীবৃদ্ধির কাজ করি।
প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন, ৯৬ পরবর্তী সময়ে তাঁর সরকার জাতীয় মসজীদের সংস্কারে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিল পরবর্তীকালের বিএনপি-জামায়াত সরকার সেগুলো বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগই আবার তা সম্পন্ন করে।
সৌদি একজন মন্ত্রী এসে পরবর্তীতে এই সংস্কারকৃত মসজিদের উদ্বোধন করেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার হাতে যেহেতু শুরু এবং আল্লাহর রহমতে আমার হাতেই তাঁর কাজ শেষ হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যখনই সরকারে এসেছি সবসময়ই উদ্যোগ নিয়েছি, আমাদের যে শান্তির ধর্ম সেটা যেন সাধারণ মানুষ যথাযথভাবে পালন করতে পারেন।
হজ ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে তাঁর উদ্যোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জীবনে বহুবার আমি হজে গিয়েছি, ওমরাহ করেছি। যদিও সৌদির রাজকীয় ব্যবস্থাপনায় হজ পালনে যেতাম কিন্তু সেখানে আমি সব সময় বাঙালি হাজিদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের খোঁজ-খবর করে সুবিধা- অসুবিধার নোট নিয়েছি এবং কিভাবে তা সুন্দর করা যায় তার পরিকল্পনাও করে রাখি। তারপরে যখন সরকারে এলাম তখন সার্বিক উন্নয়নের পদক্ষেপ নিয়েছি।
তিনি বলেন, আমাদের সরকার সৌদি আরবের সঙ্গে মিলে হাজিদের সুবিধার জন্য যাতায়াতের বিমান, সেখানে বাসা-বাড়ি, ট্রান্সপোর্ট’সহ সব রকমের উন্নয়নের পদক্ষেপ নিয়েছে। আগে হজ অফিস শুধু জেদ্দায় ছিল সেখানে আমরা মক্কা শরীফে বাংলাদেশ মিশনের সামনেও হাজীদের সুবিধার্থে হজ অফিস নির্মাণ করে দিয়েছি। আমরা ৫ বছর মেয়াদি জাতীয় হজ ও ওমরাহ নীতি প্রণয়ন করে কাজ করে যাচ্ছি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সারাদেশের ইউনিয়ন পর্যায়ের ডিজিটাল সেন্টার-৫৭২৫টি ইউনিয়ন তথ্য কেন্দ্র থেকে হজযাত্রীদের জন্য সারাবছরব্যাপী হজ রেজিষ্ট্রেশনে ব্যবস্থা করেছি। যেন হজের সময় খুব বেশি চাপ না পড়ে এবং এই রেজিষ্ট্রেশনের মাধ্যমে হাজীদের নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা কঠোর নজরদারিতে রেখেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেন হজ বা ওমরা’র নাম করে সৌদি আরবে গিয়ে কেউ থেকে না যায়- সৗদি সরকারের সবসময়য়কার এই আপত্তির প্রেক্ষিতে আমরা সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছি।
হজ ব্যবস্থাপনাকে সরকার সুষ্ঠু কাঠামোবদ্ধ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা এ বছর রেজিষ্ট্রেশন করেছেন কিন্তু হজে যেতে পারেননি, তাঁরা আগামীবার যেন অগ্রাধিকার পান সে বিষয়ে সরকার খেয়াল রাখবে। তিনি বিষয়টির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, হজের জন্য ওয়েব পোর্টাল করে দিয়েছি-(িি.িযধলল.মড়া.নফ) তাছাড়া মোবাইল এসএমএস’র মাধ্যমেও হজ যাত্রীদের যাবতীয় তথ্য ও হজ সম্পর্কিত সকল তথ্য যে কেউ পেতে পারেন। কেননা সকল হজ যাত্রীদের একটি ডাটাবেজ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ই -হজ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেহেতু সৌদি নরকার ই-হজ ব্যবস্থাপনা চালু করেছে তাই তার সাথে তাল মিলিয়ে আমরাও দেশে ই-হজ ব্যবস্থাপনা চালু করেছি এবং বারকেড রিপার’সহ প্রয়োজনীয় সকল আধুনিক প্রযুক্তগত সুবিধা সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
জেদ্দায় হাজিদের অসুবিধা নিরসসে সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগে জেদ্দায় টার্মিলালে গিয়ে অনেককে বসে থাকতে হত। যে কারণে আমরা নিজস্ব উদ্যোগে সেখানে একটি প্লাজা ভাড়া নিয়েছি। যেখানে হাজীদের মালপত্র আনা-নেয়া,তথ্য প্রযুত্তি’সহ সব রকমের সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি চিকিৎসা সেবা প্রদানেরও সুযোগ থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী আশকোনা হাজী ক্যাম্পের উন্নয়নে এবং হাজীদেরও প্রশিক্ষণ প্রদানে তাঁর সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী সৌদি বাদশাহকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, যেহেতু আমাদের এখান থেকে বেশিসংখ্যক লোক হজে যেতে চান তার ব্যবস্থা সৌদি সরকার করে দিয়েছে। এজন্য তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাই, ধন্যবাদ জানাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার যেকোন দেশের চাইতে হজ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে এবং সবসময় সব থেকে ভালো অবস্থায় রয়েছে। এজন্য সৌদি হজ মন্ত্রণালয়ও বাংলাদেশের ব্যাপক প্রসংশা করছে এবং ২০১৪ সালে শ্রেষ্ঠ হজ ব্যবস্থাপনার স্বীকৃতি দিয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী হজ যাত্রীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে যে বলেন, যে নিয়তে হজে যাচ্ছেন সেই নিয়ত পুরো করে সুস্থ শরীরে যেন ফিরে আসতে পারেন-সেই কামনাই করি। তিনি এ সময় সমগ্র দেশ ও জাতির জন্য হজযাত্রীদের কাছে দোয়া কামণা করেন।
তিনি বলেন, আমরা দেশকে ভালবাসি আপনাদের কাছে এটুকু কামনা দেশের জন্য দোয়া করবেন, দেশের মানুষের জন্য দোয়া করবেন এবং যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি-জাতির পিতার স্বপ্নের দারিদ্র মুক্ত সোনার বাংলাদেশ যেন আমরা গড়ে তুলতে পারি। দেশের মানুষ যেন শন্তিতে বসবাস করতে পারে। জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসের হাত থেকে মানুষ যেন মুক্তি পায়, উন্নত জীবন পায়- সেজন্য অপনাদের কাছে দোয়া চাই।
তিনি দেশ ও জাতির পশাপাশি ব্যক্তিগত ভাবেও নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া চান।