ঢাকা, ১১ মে ২০১৬ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল প্রযুক্তি নির্ভর সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, আকাশ সংস্কৃতির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে ভাল চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন আকাশ সংস্কৃতি চলে এসেছে। বলতে গেলে সবকিছু এখন মুক্ত হয়ে গেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার চলে আসায় কোথাও কিছুই আর নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখার সুযোগ নেই। যে কারণে প্রতিযোগিতাও অনেক বেড়ে গেছে। সে জন্য এই শিল্পের বিকাশে আরো যতœবান হতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৪ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন একটা বিষয় খেয়াল রাখা দরকার, আমাদের সমস্ত প্রদর্শনীগুলো যেন আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তির হয়।’
আন্তর্জাতিকমানের চলচ্চিত্র নির্মাণের মেধা মনন ও শক্তি আমাদের দেশের চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলা কুশলীদের রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সবক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছি। কাজেই এক্ষেত্রেও আমরা পিছিয়ে থাকবো না।’
তিনি চলচ্চিত্র কলা কুশলীদের এগিয়ে যাবার আহবান জানিয়ে প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ সুবিধা প্রদানের ও আশ্বাস দেন।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি একেএম রহমতউল্লাহ এমপি। তথ্য সচিব মরতুজা আহমেদ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৪ বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।
মোট ২৮টি শাখায় বিজয়ীদের অনুষ্ঠানে পুরস্কৃত করা হয়। বিশিষ্ট অভিনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা সেয়দ হাসান ইমাম এবং অভিনেত্রী রাণী সরকার চলচ্চিত্র শিল্পে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ আজীবন সন্মাননা লাভ করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, মন্ত্রী পরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্য, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় দপ্তর ও বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, কূটনৈতিক মিশনের সদস্য, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি, চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কলাকুশলী এবং শিল্পীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় ১০৫ একর জমির ওপর বঙ্গবন্ধু ফিল্ম সিটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ সহ চলচ্চিত্র শিল্পের ডিজিটাইজেশনে তাঁর সরকার গৃহিত বিভিন্ন পদক্ষেপের চিত্র তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুদান দিয়ে যাচ্ছে, পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণেও সরকার অনুদান দিচ্ছে।
তাঁর সরকার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি চলচ্চিত্র ও খেলাধূলা উন্নত এবং মানুষের বিনোদনের ক্ষেত্রটিকে প্রশস্ত করায় বিশেষ দৃষ্টি রখেছে বলেও তিনি জানান।
এ সময় জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালার খসড়া প্রণীত হওয়ায় শীঘ্রই এটি মতামতের জন্য ওয়েব সাইটে উন্মুক্ত করে দেয়ার কথাও জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য প্রযুক্তির দরকার হয়। জাতির পিতা স্বাধীনতার পরে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন- এরপর বহু বছর কেটে গেছে। জাতির পিতাকে হত্যা করা হলো। অপসংস্কৃতি এখানে ঢুকতে শুরু করলো।.. আর কোন প্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষ সাধন হলো না।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ’৯৬ সালে সরকার গঠনের পর চলচ্চিত্রের যে অবস্থা দেখলাম, সেখানে আধুনিক প্রযুক্তির কোন ব্যবহার শুরু হয়নি। পুরনো মান্ধাত্মার আমলের সবকিছু। অত্যন্ত সীমিত সুযোগের মধ্য দিয়েই চলচ্চিত্র তৈরী হচ্ছিল। কোন নীতিমালাও ছিল না যার জন্য একটা সময় দেখা যায় মানুষ চলচ্চিত্র বিমুখ হয়ে গিয়েছে।
তিনি বলেন, একটা কথা মনে রাখতে হবে আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম কিন্তুু চলচ্চিত্র। পরিবারের সঙ্গে বা ছুটি ছাটায় সিনেমা দেখা একটা আগ্রহের বিষয় ছিলো, যে আগ্রহটা হারিয়ে গিয়েছে।
অনেকেই চলচ্চিত্রের দিকে আবার দৃষ্টি ফেরাচ্ছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে চলচ্চিত্রের আবার সময় ফিরেছে। তবে, চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সুস্থ ধারার বিনোদনের সঙ্গে শিক্ষামূলক কিছু রেখেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, চলচ্চিত্র এমন একটি গণমাধ্যম যেখানে মাটি ও মানুষের কথা, সুখ-দুঃখ ও হাসি-কান্নার সচিত্র প্রতিফলন ঘটে। তাই নির্মাতাদের প্রতি আমার অনুরোধ, দর্শকরা ছবি দেখে যাতে কিছু শিখতে পারে এবং এগুলো প্রয়োগ করে সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে সেদিকটিতে খেয়াল রাখবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, চলচ্চিত্রের উন্নয়নের ক্ষেত্রে শুধু সরকারি পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়। আমি আশা করি দেশের বিত্তবানেরা এ শিল্পের উন্নয়নে এগিয়ে আসবেন।
তিনি বলেন, ব্যবসা পরিবর্তনের স্বার্থে অনেক হল মালিক তাদের সিনেমা হল ভেঙে ফেলছেন। অথচ এটিকে আরও আধুনিক করলে ব্যবসা ও সুস্থ সামাজিক বিনোদনের সুযোগ তৈরি করা যায়। যা সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশও বটে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমাজকে এই বার্তা দেয়া প্রয়োজন যে, অশুভ শক্তির দমন সম্ভব। চলচ্চিত্র হতে পারে তার অন্যতম মাধ্যম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দর্শকদের হলে ধরে রাখতে হলে একদিকে যেমন ভালো ছবি নির্মাণ করতে হবে, তেমনি সিনেমা হলের পরিবেশও সুন্দর করা প্রয়োজন।
চলচ্চিত্র শুধু বিনোদনই নয়, শিক্ষা এবং সমাজ সংস্কারের ও পরিবর্তনের মাধ্যম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের এসব দিকে নজর দিতে হবে, সময়ের চাহিদার সঙ্গেও তাল মিলিয়ে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, রঙেরও চাহিদা পাল্টায়। একেক সময় একেক রঙ মানুষের ভালো লাগে। এগুলো বুঝতে হলে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, লেখাপড়া প্রয়োজন। আর এ কারণেই জাতীয় চলচ্চিত্র ইনষ্টিটিউট গড়ে তোলা হয়েছে। নিজস্ব ক্যাম্পাস দেয়া হয়েছে।
অধ্যয়ন ও গবেষণা চলচ্চিত্রের মান উন্নয়নের অপরিহার্য অংশ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার চলচ্চিত্র নির্মাণ, চলচ্চিত্র বিষয়ে অধ্যয়ণ, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী নিজেও হলে গিয়ে সুযোগ না হলেও বিমান ভ্রমনকালে চলচ্চিত্র দেখেন এবং সাম্প্রতিককালের কয়েকটি চলচ্চিত্রই তাঁর মনে দাগ কেটেছে বলেও উল্লেখ করেন।
বক্তৃতার শুরুতেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছিলেন উল্লেখ কওে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল তখনকার প্রাদেশিক আইন পরিষদে ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা বিল’ উত্থাপন করে এদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নতুন মাইলফলক রচনা করেন বঙ্গবন্ধু। তখন চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা বিল পাশ হয়। সে সময় বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও পল্লী সহায়তা মন্ত্রী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক পদক্ষেপের ফলেই আজকের ‘চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ এফডিসি’র সৃষ্টি হয় বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান।