‘মহাসচিব’ পদ নিয়ে জাতীয় পার্টিতে (জাপা) সৃষ্ট ঝড় প্রায় থেমে গেছে। এখন মূল দ্বন্দ্ব চলছে দলের ‘কো-চেয়ারম্যান’ পদ নিয়ে। চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ তার ছোট ভাই জিএম কাদেরকে ‘কো-চেয়ারম্যান’ করায় বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না রওশন এরশাদ। দ্বন্দ্ব নিরসনে রওশনকে এক নম্বর ‘কো-চেয়ারম্যান’ করে জিএম কাদেরকে দুই নম্বর ‘কো-চেয়ারম্যান’ করার কথা উঠলেও এরশাদ তাতে সায় দেননি। বরং প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে ‘কো-চেয়ারম্যান’ হিসেবে জিএম কাদেরের হাতে গতকাল ‘নিয়োগপত্র’ তুলে দিয়েছেন তিনি।
রওশনকে ‘কো-চেয়ারম্যান’ না করার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে এরশাদ বলেছেন ‘আমি রওশন এরশাদকেই দলের কো-চেয়ারম্যান করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রওশনের বয়স এখন ৭৬। তিন বছর পর নির্বাচন হলে তখন তার বয়স হবে ৭৯। তার বয়স হয়ে গেছে, এজন্য তাকে কো-চেয়ারম্যান করিনি। বয়স কম হওয়ায় জিএম কাদেরকে পার্টির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছি।’ গতকাল দুপুরে এরশাদ তার বনানী কার্যালয়ে নবনিযুক্ত কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের এবং দুই বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে আবারও মহাসচিব হওয়া এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে বরণ করে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া অনুষ্ঠানে একথা বলেন।
মঙ্গলবার জাপার পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক সম্পর্কে গতকাল জাপার কয়েকজন সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈঠকে জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করা নিয়ে হইচই করেন কয়েকজন। বৈঠকে সভাপতিত্বকারী রওশন এরশাদও এনিয়ে আপত্তি জানান। বিশেষ করে, পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু এর ঘোর বিরোধিতা করেন।
এরশাদের উদ্দেশে বৈঠকে ব্যারিস্টার আনিস বলেছেন, ‘আপনার আপন ভাই, শুধুমাত্র এই কারণেই একটি লোককে আপনি দলের কো-চেয়ারম্যান করে ফেললেন? এটা তো কোনো পার্টি হতে পারে না, গণতন্ত্র হতে পারে না, রাজনীতিও হতে পারে না।’
ব্যারিস্টার আনিসকে সমর্থন করে প্রতিমন্ত্রী চুন্নুও এসময় বলেন, ‘জিএম কাদের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, বর্তমান সরকার ও সংসদ-সবকিছুকেই অবৈধ বলেছেন। তাহলে আমরা এই সংসদের সদস্য ও মন্ত্রী হয়ে কীভাবে জিএম কাদেরের অধীনে রাজনীতি করবো?’ জিএম কাদের অবশ্য ইত্তেফাককে বলেছেন, তিনি ওই ধরনের কোনো কথা বলেননি।
ব্যারিস্টার আনিসকে সমর্থন করে প্রতিমন্ত্রী চুন্নুও এ সময় বলেছেন ‘জিএম কাদের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, বর্তমান সরকার ও সংসদ-সবকিছুকেই অবৈধ বলেছেন। তাহলে আমরা এই সংসদের সদস্য ও মন্ত্রী হয়ে কীভাবে জিএম কাদেরের অধীনে রাজনীতি করবো?’ জিএম কাদের অবশ্য ইত্তেফাককে বলেন, তিনি ওই ধরনের কোনো কথা বলেননি।
সংসদীয় দলের বৈঠক সূত্র জানায়, মুখের সামনে দলীয় নেতা-এমপিদের উত্তেজিত আচরণে ‘থ’ বনে যান এরশাদ। এক পর্যায়ে এরশাদ বলেন, ‘ঠিক আছে, আপনারা সাদা কাগজ নিয়ে আসুন-আমিই বরং পদত্যাগ করি।’ গতকালও বনানী কার্যালয়ে এরশাদ বলেছেন ‘আগামী এপ্রিলে জাপার যে কাউন্সিল হবে, সেখানে যদি নেতা-কর্মীরা আমাকে দলীয় চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দিতে বলেন, আমি আর এ পদে থাকব না।’
পদত্যাগের হুমকি দেয়ায় সংসদীয় দলের বৈঠকে এরশাদের উদ্দেশে রওশন বলেন ‘তোমাকে পদত্যাগ করতে হবে না, তুমিই চেয়ারম্যান’। এনিয়ে বাগ্যুদ্ধের পর রওশনের সম্মতিতে বৈঠকে বেশিরভাগ সদস্য প্রস্তাব দেন যে, রওশনকে প্রথম এবং জিএম কাদেরকে দ্বিতীয় কো-চেয়ারম্যান করা হলে সংকট কেটে যাবে। এতে এরশাদও এক ধরনের সম্মতি দিয়ে আসেন। তবে পরদিন, অর্থাত্ গতকাল এরশাদ সেটি নাকচ করে জিএম কাদেরকেই ‘কো-চেয়ারম্যান’ হিসেবে লিখিত দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন।
এদিকে, দলে চলমান সংকট সম্পর্কে প্রথমবারের মতো মুখ খুলেছেন রওশন এরশাদ। গতকাল রওশন এরশাদ সংসদ ভবনে তার কার্যালয়ে ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন ‘না জেনেশুনে পত্রপত্রিকায় অনেক কিছু লেখালেখি হচ্ছে, যা নিয়ে সারাদেশে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। আমি তো দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হইনি, এ ধরনের কোনো প্রস্তাবও ওঠেনি। বাবলুকে (সদ্য বাদ পড়া মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু) বলেছিলাম, শুধু লিখিত বক্তব্যে যেটি ছিল সেটি ব্রিফিংয়ে পড়ার জন্য। সেখানে আমাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে কিছু ছিল না। অথচ মিডিয়ায় আসলো-আমি নাকি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এটা সম্পূর্ণ অসত্য ও বিভ্রান্তিকর।’
রওশনের এই বক্তব্যের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় এরশাদের কথায়। এরশাদও গতকাল বলেছেন, ‘বাবলু (জিয়াউদ্দিন বাবলু) সেলিফস (স্বার্থপর)। সে আমার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আমার স্ত্রীর অসম্মতিতে তাকে পার্টির কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছে। এজন্যই তাকে মহাসচিব থেকে বাদ দিয়েছি।’ আর রুহুল আমিন হাওলাদার প্রসঙ্গে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি হঠাত্ করেই রুহুল আমিনকে মহাসচিব পদ থেকে বাদ দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি। তিনি চুপ ছিলেন। তাই তাকেই আবার মহাসচিব করেছি।’
এদিকে, দলের কো-চেয়ারম্যান পদের বিষয়ে রওশন ইত্তেফাককে বলেন, ‘সংসদীয় দলের বৈঠকে আমিও এরশাদ সাহেবকে বলেছি-কারও সঙ্গে আলোচনা না করে এভাবে রংপুরে গিয়ে হঠাত্ করে একজনকে কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করা ঠিক হয়নি। সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হতো। প্রয়োজনে দলের প্রেসিডিয়াম বৈঠক ডেকে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা উচিত, এটাও আমি বলেছিলাম।’
সবকিছু নিয়ন্ত্রণে: এরশাদ
গতকাল সংসদ অধিবেশনে যোগদানের প্রাক্কালে ইত্তেফাকের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপকালে এরশাদ বলেন, ‘আমার দলে কোনো সংকট নেই। সবকিছু নিয়ন্ত্রণে, সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে।’ দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার এ সময় এরশাদের সঙ্গে ছিলেন।
বিএনপির বিকল্প দল গড়তে চাই
বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে এরশাদ বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে আর থাকতে চান না। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবেন যেন তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী যেন মন্ত্রিসভায় থাকা তার দলের নেতাদেরও অব্যাহতি দেন। জাপাকে তিনি সত্যিকারের বিরোধী দল হিসেবে গড়তে চান। নিজে দূতের পদ ছেড়ে এবং মন্ত্রিসভা থেকে দলের নেতাদের বের করে এনে বিএনপির বিকল্প দল হিসেবে জাপাকে শক্তিশালী করতে চান বলেও বিবিসিকে জানান এরশাদ।
মন্ত্রীদের বের করে আনতে এরশাদ-রওশন একমত
সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে দলের তিন নেতা—পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গাকে বের করে আনার বিষয়ে এরশাদ ও রওশন একাট্টা। এরশাদ ও রওশনের সঙ্গে পৃথকভাবে এ নিয়ে কথা বলে জানা গেছে, তারা দুজনই চান জাপা শুধুই বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করুক।
তবে এরশাদ-রওশনের এই চাওয়ায় মত নেই মন্ত্রিসভায় থাকা দলের ওই নেতার। এক প্রতিমন্ত্রী ইত্তেফাককে বলেন, ‘এরশাদ আমাদের এমপি বানাননি, কারণ উনি নির্বাচনের বিপক্ষে ছিলেন। আমরা নিজেরাই এমপি হয়েছি। আর আমাদের মন্ত্রী করেছেন শেখ হাসিনা। তা হলে আমরা কেন এরশাদের কথায় পদত্যাগ করতে যাব?’ এ ব্যাপারে জাপার প্রেসিডিয়ামের এক সদস্য ইত্তেফাককে বলেন, ‘যারা মন্ত্রিসভায় রয়েছেন, তাদের মাধ্যমে দলের অন্য কেউ উপকৃত হচ্ছেন না, দলেরও কোনো উপকারে আসছে না। তারা শুধু নিজেদের সুবিধার জন্য মন্ত্রিসভায় থেকে পুরো বিরোধী দলকে সমালোচনায় ফেলছেন।’