প্রথম আলো: এটা কিসের সংকট— স্ত্রী বনাম স্বামী–দেবর, নাকি গণতন্ত্রের সংকট?
জি এম কাদের: যেটা বাহ্যত সংকট, আসলে সেটা সংকট উত্তরণের উপায়। দল সংকটে আগেই ছিল। এটা থেকে বেরোতে এখন বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।
প্রথম আলো: রওশন এরশাদ সত্যিই পরিবর্তন চেয়েছেন?
জি এম কাদের: রওশন তিনজনের মন্ত্রিত্ব ছাড়তে ও নিজে বিরোধী দলের নেতার ভূমিকা পালনের পক্ষে, সেটা তিনি নিজেই বলেছেন। তাঁর মতের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই।
প্রথম আলো: আপনাকে কো-চেয়ারম্যান করার আইডিয়া কী করে এল? নেপথ্যের গল্পটা জানতে চাই।
জি এম কাদের: আমি দুই সপ্তাহ আগে একটি পারিবারিক কারণে রওশনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তখন তিনি নিজেই বললেন, দল বাঁচাতে হবে। তোমার ভাই তোমাকে কো-চেয়ারম্যান করতে পারেন। আমি বললাম, এমন পদ তো গঠনতন্ত্রে নেই। তিনি বললেন, চেয়ারম্যানের ক্ষমতা আছে পদ সৃষ্টি করার। পরে তা আমি ভাইকে জানাই। আর সত্যি বলতে দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের প্রবল দাবি ছিল আমি একটা কার্যকর ভূমিকা পালন করি। দল আগে যেভাবে সম্মান ও গুরুত্ব পেত, সরকারের সঙ্গে থাকার জন্য এখন তা পাচ্ছে না। আমরা মানুষের ঠাট্টার পাত্র হচ্ছি।
প্রথম আলো: কো-চেয়ারম্যান মানে আপনি এখন দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি। রওশনের অবস্থান?
জি এম কাদের: কো-চেয়ারম্যান হলো চেয়ারম্যানের কাছাকাছি মর্যাদা। প্রেসিডিয়াম ও মহাসচিবের ওপরে। সংসদীয় দলে চেয়ারম্যানের সমতুল্য দলে ওভাবে কাউকে ধরা হয় না।
প্রথম আলো: আপনি আসায় নতুন কিছু দেখা যাবে? দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চালু করবেন? পকেট কমিটি বন্ধ করবেন?
জি এম কাদের: অবশ্যই। আমি ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতি করিনি।
প্রথম আলো: আপনাকে আবার মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিলে?
জি এম কাদের: দিলে মনে হয় এ মুহূর্তে নিতে পারব না। দলের সিদ্ধান্তের ব্যাপার আছে।
প্রথম আলো: তার মানে দল চাইলে নেবেন?
জি এম কাদের: সেটা দল কী পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে বলবে, তা বুঝতে হবে। তবে দল এখন এমন সিদ্ধান্ত দেবে না। দিলেও আমার তা নেওয়া ঠিক হবে না। এ মুহূর্তে মানুষের যে প্রত্যাশা, তার সঙ্গে এটা যায় না।
প্রথম আলো: জাপার এই পরিবর্তনের সঙ্গে আগাম বা মধ্যবতী নির্বাচনের কোনো যোগসূত্র?
জি এম কাদের: এটাই মূল বিষয়। নির্বাচনের মাধ্যমেই কোনো দলের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক তৈরি হয়। সেখানে জাপাকে নিয়ে একটি বিভ্রান্তি চলছে। প্রতিদিন আমরা এ জন্য জনপ্রিয়তা হারাচ্ছি। সবশেষ নির্বাচনেও তাই ফুটে উঠেছে। সরকারি দলের পরিবর্তে ধানের শীষ বা অন্য দলকে বেছে নিয়েছে, জাপাকে নয়।
প্রথম আলো: এখনই আগাম নির্বাচন চান?
জি এম কাদের: ব্যক্তিগতভাবে চাই। দল সিদ্ধান্ত নেয়নি।
প্রথম আলো: এরশাদ ও রওশন চান?
জি এম কাদের: এরশাদেরটা শুনিনি। তবে যত দূর বুঝতে পারি, যাঁরাই জাপার সাংসদ, তাঁরা চান না। ৪০ জন এমপির মধ্যে ২৩-২৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হয়েছেন। সরকার বা ইসির প্রতি তাঁদের একটা আনুগত্য বা স্বাভাবিক কৃতজ্ঞতা থাকা স্বাভাবিক। জাপা এখন দুই ধারায় বিভক্ত। বলা চলে সংসদ রক্ষার দিকে ১০ ভাগ আর দ্রুত নির্বাচনের দিকে ৯০ ভাগ।
প্রথম আলো: সংখ্যাগরিষ্ঠ ধারাটি তাহলে সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবির দিকে ঝুঁকছে?
জি এম কাদের: এটা আমি এখনই বলতে পারব না। তবে এটা জোর দিয়ে বলতে পারি, জাপার প্রায় সবাই চাইছে সরকার থেকে সরে এসে সক্রিয় রাজনীতি করতে।
প্রথম আলো: জাপার তিন মন্ত্রী পদত্যাগ করলেই আপনারা সংসদে কার্যকর বিরোধী দল হবেন?
জি এম কাদের: চেষ্টা করব। সংসদ এমন একটি ফোরাম, যাকে বাইরে সহজে পাওয়া যায় না। বাইরে যা বলা যায় না, তা সংসদে বলা যায়। মন্ত্রী না থাকলেই বরং সংসদে আমরা সক্রিয় রাজনীতিটা করতে সচেষ্ট হব। অতীতের রাজনীতিতে আমরা শক্তিশালী ছিলাম বলে আওয়ামী লীগকে আমরা সহযোগিতা করতে পেরেছি। আমাদের সহযোগিতা ছাড়া আওয়ামী লীগ কখনো সরকার গঠন করতে পারেনি। জাপাকে তাদের লাগবে।
প্রথম আলো: কীভাবে, ব্যাখ্যা করুন?
জি এম কাদের: ১৯৯৬ সালে জাপাকে নিয়ে তারা সরকার গঠন করেছে। ২০০১ সালে আমাদের সঙ্গে তারা জোট করেনি, হেরেছে। ২০০৮ সালে মহাজোট করেছে, জিতেছে। ২০১৪ সালেও তারা জাপাকে নিয়েই সরকার গঠন করেছে। অ্যান্টি আওয়ামী লীগ ভোট ব্যাংক বিএনপিকে সঙ্গে পেয়েছিল বলে ১৯৯০ সালে তারা এরশাদের পতন ঘটাতে পেরেছিল। এখন জাপা পরিচয়-সংকটে ভুগছে। বিএনপিকে ভোট না দিলে মানুষ এখন আওয়ামী লীগ বা স্বতন্ত্র প্রার্থীকে দিচ্ছে।
প্রথম আলো: তাহলে তো দেখছি, এটা গণতন্ত্রের কোনো ব্যাপার নয়। এটা ঘটছে এমন এক সময়, যখন জনপ্রিয়তা পড়তির দিকে। তখন কি সরকারি দলের বিপরীতে একটা অধিকতর গ্রহণযোগ্য বিরোধী দল দরকার?
জি এম কাদের: আমি এভাবে বলব না।
প্রথম আলো: জাপার তিন মন্ত্রী না থাকলে জাপাই শক্তিশালী হবে, নাকি আওয়ামী লীগকে তা দুর্বল করবে?
জি এম কাদের: না, মন্ত্রিসভা ত্যাগ করলে সরকারের দুর্বল হওয়ার কারণ নেই। জাপার শক্তিশালী হওয়া মানে আওয়ামী লীগের দুর্বল হওয়া নয়। জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে আমরা তখন সংসদে ও বাইরে আন্দোলন করব।
প্রথম আলো: আগাম নির্বাচনকে দলীয় সিদ্ধান্ত করতে উদ্যোগী হবেন?
জি এম কাদের: আমি মনে করি, ধার ও ভারে নেতা হয় না। সবার মতামত নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
প্রথম আলো: এর মানে আপনার উত্থানে সরকারকে অতটা সন্ত্রস্ত না হলেও চলবে। কারণ, জাপাকে আপনি দাবড়ে আগাম নির্বাচনে ঠেলতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবেন, এটা আপনার অবস্থান নয়?
জি এম কাদের: যেকোনো কাজ করতে গেলে একক ব্যক্তির পক্ষে কিছু করা সম্ভব হয় না। কোনো নেতার চাপানো সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় না। তবে আমার মতে, যদি তারা প্রভাবিত হয় সেভাবে সিদ্ধান্ত হবে।
প্রথম আলো: এরশাদ বিশেষ দূত থেকে পদত্যাগ করলে অবাক হবেন?
জি এম কাদের: আমি অবাক হব না। যেকোনো মুহূর্তে তিনি পদত্যাগ করতে পারেন। তবে সেটা করে তিনি সরকারকে বিব্রত করতে চান না। সৌজন্য রক্ষা করতে চান।
প্রথম আলো: মন্ত্রীদের পদত্যাগে দলের সিদ্ধান্ত আসন্ন? সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য হলে?
জি এম কাদের: এটা নিয়ে দলের ভেতরে দাবি আছে। তবে আসন্ন কি না, তা এখনই বলতে পারব না। সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য হলে তাঁরা দল থেকে বহিষ্কার হতে পারেন।
প্রথম আলো: আপনার কো-চেয়ারম্যান হওয়া ছাড়া কোনো গুণগত পরিবর্তন? মহাসচিব অদলবদল তো আগেও হয়েছে?
জি এম কাদের: না, প্রক্রিয়াগত কোনো পরিবর্তন নেই।
প্রথম আলো: আপনি যে প্রক্রিয়ায় পদোন্নতি পেলেন, এটা গণতান্ত্রিক?
জি এম কাদের: গণতান্ত্রিক এই অর্থে যে চেয়ারম্যানকে ক্ষমতা দেওয়ার বিধানযুক্ত দলীয় গঠনতন্ত্রে নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন রয়েছে। দুই বড় দলেরও এমন বিধান আছে। তারাও ইসিকে বলেছে, শৃঙ্খলা মানতে এমনটাই জুতসই।
প্রথম আলো: ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতার বিপক্ষে আপনার লেখালেখি, অথচ নিজের বেলায় অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেওয়া সিদ্ধান্তের সাফাই গাইছেন, এটা স্ববিরোধিতা নয় কি?
জি এম কাদের: কোনো একব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করায় ব্যক্তিগতভাবে আমার সায় ছিল না, এখনো নেই।
প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনে যাবেন?
জি এম কাদের: ত্রয়োদশ সংশোধনী বিলের পক্ষে আমরা ভোট দিয়েছিলাম। তবে ৫ জানুয়ারি ও পরের নির্বাচনগুলো এবং বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনার ও বিচারকদের অপসারণের বিধান সংসদের হাতে নেওয়া মানে প্রধানমন্ত্রীর বলয়ে যাওয়া এবং সাংবিধানিক পদগুলো দলীয়করণের প্রেক্ষাপটে অবস্থা বদলেছে। সবকিছু ব্যক্তির হাতে চলে গেছে। বাস্তবে নিয়ন্ত্রণ চলছে কি চলছে না, সেটা আমি বলছি না, তবে ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের কারণে বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে নির্বাহী বিভাগের সামনে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথম আলো: তার মানে ত্রয়োদশ সংশোধনী ফেরত চাইছেন?
জি এম কাদের: ব্যক্তিগতভাবে দুটি প্রস্তাব আছে। নির্দলীয় সরকার হতে পারে। আবার প্রধানমন্ত্রী থাকলে নির্বাচনকালে তাঁর ক্ষমতা কিছুটা নয়, ব্যাপকভাবে হ্রাস ও নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন করতে হবে। সংবিধান সংশোধন না করেও এটা পারা যায়। না হলে সরকার যেখানে চাইবে সুষ্ঠু হবে, যেখানে চাইবে না সেখানে সুষ্ঠু হবে না।
প্রথম আলো: নির্বাচনকালীন সরকারে জাপা মন্ত্রিত্ব নেবে?
জি এম কাদের: আমার মনে হয় এটা উত্তম প্রস্তাব। যেমন জনপ্রশাসন সরকারের হাতছাড়া করতে হবে।
প্রথম আলো: এরশাদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো মামলা কি আছে, যা তাঁকে নির্বাচনে অযোগ্য করতে পারে?
জি এম কাদের: মঞ্জুর হত্যা মামলা। রায়ের অপেক্ষায় থাকার পর্যায় থেকে পুনরায় তদন্তে গেছে। তবে তাতে তিনি অযোগ্য হতে পারেন, তা আমি মনে করি না।
প্রথম আলো: জাপার ভাঙন কিংবা নতুন মেরুকরণ সম্পর্কে আপনার ভাবনা?
জি এম কাদের: ব্রাকেটবন্দী জাপার সম্ভাবনা নাকচ করি না, আওয়ামী লীগ আমলে আগেও হয়েছে। এটা আবার হলে জাপা আবার শক্তিশালী হবে। ১৯৯০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত একটা ধারা চলেছে, সেটা মরে গেছে। এখন সামনে নতুন ধারার সূচনার সম্ভাবনা দেখছি। তবে তাতে কে উপকৃত হবে, তা জানি না। তবে আসন্ন নির্বাচন জোটগত হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। কোনো বড় দলই এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে পারবে না।
প্রথম আলো: কেউ কেউ বলছেন, আপনারা কারও ইঙ্গিতে নড়াচড়া দিচ্ছেন। কারণ, একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক বিরোধিতার পরিবেশ সরকারের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত।
জি এম কাদের: (হাসি) আমার মনে হয় না এমন কিছু হচ্ছে। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে আমি জানি, তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি। তিনি বর্তমান অবস্থাকে স্বস্তিকর মনে করছেন না। আমার বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রী একটি গ্রহণযোগ্য মধ্যবর্তী নির্বাচনের দিকে যেতে পারেন।
প্রথম আলো: সেই সংসদে আপনাকে তিনি একজন অধিকতর গ্রহণযোগ্য বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দেখতে আগ্রহী হবেন? তিনি সংসদ নেতা, আপনি বিরোধী দলের নেতা, দৃশ্যটি কেমন লাগবে?
জি এম কাদের: (হাসি) তাঁর মনে কী আছে তা আমি জানি না। তাঁর মন তো আমি জানি না। তবে এমন দৃশ্য নিশ্চয় আমার খারাপ লাগবে না।
প্রথম আলো: ধন্যবাদ
জি এম কাদের: আপনাকেও ধন্যবাদ।