শুধু সরকারের উপর নির্ভরশীল নয় দশে মিলে কাজ করলে যে সফলতা আসে তার প্রমাণ রাখলেন বেলকুচি উপজেলার ছয় গ্রামের বাসিন্দারা। নিজেদের উদ্যোগে হুরাসাগর নদীর উপর একটি বিশাল বাশেঁর সাকো তৈরি করে এতদিন ধরে বিচ্ছিন্ন থাকার বিশৃঙ্খল জীবন থেকে মুক্ত হয়েছেন।
শুক্রবার বিকেলে এই বাঁশের সাকোটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলেন উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। উদ্বোধন করতে আসা অতিথিরাও এজন্য নিজেদের লজ্জার কথা জানালেও গ্রামবাসীর এই উদ্যোগে তারাও গর্বিত। আগামীতে এই স্থানে একটি স্থায়ী ব্রিজ নির্মাণেরও প্রতিশ্রুতি দিলেন তারা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাঙ্গাবাড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলীর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন, বেলকুচি উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী আকন্দ। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম ইউসুফ জী খান, সিনিয়র সহসভাপতি লুৎফর রহমান মাখন, সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক সরকার, সাংগঠনিক সম্পাদক হান্নান তালুকদার, ভাঙ্গবাড়ী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন প্রামানিক ও উদ্যোক্তা ইমদাদুল হক এমদাদ।
বেলকুচি উপজেলা সদর থেকে কয়েক কিলোমিটার পশ্চিম দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে হুরাসাগর নদী। এই নদীর এ পাড়ে বানিয়াগাঁতী দক্ষিণ পাড়া এবং নদীর অপরদিকে জোকনালা, চরজোকনালা, ভুতিয়াপাড়া, ক্ষিদ্রজোকনালা, সগুনা, শেলবরিষা গ্রাম। মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে উপজেলা সদর অবস্থিত হলেও হুরাসাগর নদীর কারণে তারা ছিলেন বিচ্ছিন্ন। এই ছয়টি গ্রামের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য অনেক কষ্ট করে নদী পাড় করে উপজেলা নিয়ে যেতেন। একই সঙ্গে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদেরও ছিল খুব কষ্ট। সেই সঙ্গে এই ছয়টি গ্রামের মানুষ কোনো গুরুতর রোগে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানো যেত না।
হাতের কাছে সব কিছু থাকতেও তারা সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এদিকে, এই ব্রিজটি না থাকায় বেলকুচি থেকে উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুর উপজেলা সদরে অনেক ঘুরপথে যেতে হয়। হুরাসাগর নদীর উপর একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হলে অল্প সময়ে বেলকুচি থেকে উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুর যাতায়াত করা সম্ভব হবে।
তাদের এই কষ্ট লাঘবের জন্য বার বার সরকারের নানা জায়গায় ধরনা দিয়েও মেলেনি তাদের কাঙ্খিত ব্রিজ। তাই ছয় গ্রামের মানুষ মিলিত হয়ে ঠিক করেন তারা নিজ উদ্যোগেই তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করবেন। এই গ্রামগুলোর মানুষ মিলিত হয়ে তাদের নেতা ঠিক করেন।
ইমদাদুল হক এমদাদকে দ্বায়িত্ব দেয়া হয় তাদের কাঙ্খিত সাফল্যের জন্য কিছু একটা করতে। এমদাদ গ্রামের উঠতি বয়সি যুবকদের সঙ্গে নিয়ে ছয়টি গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে একটি করে বাঁশ ও যার যা সাধ্য আছে সেই মতো সাহায্য তুলে চরজোকনালা ত্রিমোহনী খেয়াঘাট এলাকায় শুরু করে দিলেন একটি বাঁশের সাকো তৈরির কাজ। দীর্ঘ দুই মাস কাজ করে তারা হুরাসাগর নদীর উপর ৬শ` ফিট দীর্ঘ সেতু নির্মাণ কাজ শেষ করেন। শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে এই বাঁশের সাকো সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া জোকনালা গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদ জানান, এতদিন ধরে অনেক কষ্ট করে উৎপাদিত পন্য বেলকুচি নিতে হতো। এই বাঁশের ব্রিজটি হওয়ায় এখন অনেক সহজেই পণ্যগুলো নেয়া সম্ভব হবে। তবে এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। আগামীতে হয়তো বাঁশের সাকোটি ভেঙে পড়বে। তার আগেই যেন সরকার তাদের স্বপ্নের সেতুটি তৈরি করে দেয়।
শেলবরিষা গ্রামের নজরুল ইসলাম জানান, হুরাসাগর উপর বাঁশের সাকোটি নির্মাণ করায় এখন এই ছয়টি গ্রামে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। খুব সহজে তারা এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করতে পারবে। কিন্তু এতদিন ধরেও সরকার তাদের এই দাবিটি পুরণ না করলেও গ্রামবাসী মিলিত হয়ে অস্থায়ীভাবে সমস্যার সমাধান করেছে। তিনি সরকারের কাছে স্থায়ী সমাধানের দাবি জানান।
ভুতিয়াপাড়া গ্রামের জিন্নত আলী জানান, এই ব্রিজটি নির্মাণ করার ফলে এখন খুব সহজেই কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেয়া সম্ভব হবে। কিন্তু আগে কোনো রোগী অসুস্থ হলে তাকে খেয়া ঘাট পার হতে না হতেই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়তে হতো। বাঁশের সাকো নির্মাণ করা হলেও এটি দীর্ঘস্থায়ী নয়। যে কারণে এখানে একটি স্থায়ী ব্রিজের প্রয়োজন।
উদ্যোক্তা ইমদাদুল হক এমদাদ জানান, গ্রামবাসীরা নিজ উদ্যোগেই এই সাঁকোটি নির্মাণ করেছেন। এই সাঁকোটি তদারকি ও মেরামত করার জন্যও দুটি পৃথক কমিটি করে দেয়া হয়েছে। তবে কতদিন এই কাজ চালানো যাবে তা বলা সম্ভব নয়। এই সমস্যার সমাধানের জন্য সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।
উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী আকন্দ জানান, ত্রিমোহনী খেয়া ঘাটের উপর একটি ব্রিজ নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যেই সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবনাটি খুব শীঘ্রই পাশ হয়ে আসলে আগামী ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে এই ব্রিজটি নির্মাণ করা সম্ভব হবে।
তবে গ্রামবাসী নিজ উদ্যোগে যে এতবড় বাঁশের সাঁকোটি তৈরি করে সাময়িক সমস্যার সমাধান করেছেন সেজন্য এই ছয়টি গ্রামের বাসিন্দাদের প্রতি সকলেই কৃতজ্ঞ। এই কাজটি করে তারা একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।