ব্যাকিং খাতে তারল্য সঙ্কটের জন্য ডেসটিনি দায়ী!

ব্যাকিং খাতে তারল্য সঙ্কটের জন্য ডেসটিনি দায়ী!

ডেসটিনি গ্রুপের অন্যতম সহযোগী প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি অবৈধ ব্যাংকিংয়ের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। এ জন্য প্রয়োজনে আইন করা হবে বলেও জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

সরকারের এই বক্তব্যে ডেসটিনি গ্রাহকদের জমানো হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা আরও জোরদার হয়েছে। গ্রাহকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।

ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির অবৈধ ব্যাংকিংয়ের তথ্য তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ তদন্ত প্রতিবেদন এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে।

প্রতিবেদনটি পাবার পর অর্থ মন্ত্রণালয় এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশনও ডেসটিনির দুর্নীতি, প্রতারণা ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করতে যাচ্ছে বলে সূত্র জানায়। দুদকে অনেকগুলো অভিযোগ জমার পর অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য আগামী রোববার নথিতে উপস্থাপন করা হবে বলে দুদক সূত্র জানায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনের পর সারাদেশে হাজার হাজার গ্রাহকদের মাঝেও বিনিয়োগকৃত টাকা হারানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে টাকা ফেরত চাচ্ছেন গ্রাহকরা। অনেক স্থানে কার্যালয়ে তালা দিয়ে শাখা কর্মকর্তারা গা-ঢাকা দিয়েছেন।

তদন্তে বলা হয়েছে, দেশে ব্যাংকিং খাতে যে তারল্য সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য ডেসটিনি দায়ী থাকতে পারে।

ডেসটিনির প্রতারণা ও দুর্নীতির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে তথ্য পেয়ে সরকার এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নড়েচড়ে বসেছে বলে জানা গেছে। তারা ডেসটিনির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, ডেসটিনির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা এরইমধ্যে ডেসটিনির অবৈধ কার্যক্রম সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়েছি। প্রতিবেদনের তথ্য ও সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ডেসটিনিসহ মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেন, এদের কার্যক্রম এখন যেন আমাদের কালচার হয়ে গেছে। এসব কালচার অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।’

ডেসটিনির আচরণে অর্থমন্ত্রী এতটাই ক্রুদ্ধ যে তিনি বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করতে প্রয়োজনে আইন করা হবে।

অন্যদিকে ডেসটিনির দুর্নীতি, প্রতারণা ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনও তদন্ত শুরু করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। দুদকের গণসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, তারা ডেসটিনির বিরুদ্ধে এর মধ্যেই অনেকগুলো অভিযোগ পেয়েছেন। অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য রোববার নথিতে উপস্থাপন করা হবে। খতিয়ে দেখা হবে ডেসটিনি কিভাবে জেলা প্রশাসকদের ঘুষ দিয়ে বিভিন্ন জেলায় ট্রি-প্ল্যান্টেশনের নামে জমি রেজিস্ট্রি করছে, গ্রাহকের টাকা দিয়ে পরিচালকদের নামে জমি কিনছে। কিভাবে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে।

সূত্র মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে গিয়ে জানতে পারে, এটি একটি ‘হায় হায় কোম্পানি’। কোম্পানির সঙ্গে জড়িত কর্তাব্যক্তিরা গ্রাহকদের জমানো হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে যে কোনো সময় চম্পট দিতে পারেন। এ কারণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন, সমবায় মন্ত্রণালয় ও সমবায় অধিদফতরকে এ ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে পরিদর্শন তদন্ত টিম। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়ে ডেসটিনির অবৈধ কার্যক্রমের কিছু অংশ জানতে পেরে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে।

ডেসটিনির ভুক্তভোগী গ্রাহকরাও অভিযোগ করে বলেছেন, কোনো ধরনের মূলধন ছাড়াই ডেসটিনি মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে হাজার হাজার কোটি টাকা বানিয়েছে। তারা প্রতিনিয়ত মানুষের কাছে নতুন প্রকল্পের অফার নিয়ে যাচ্ছে। তাদের কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হলে যে কেউ বছরের মাথায় কোটিপতি হয়ে যেতে পারেন, এমন প্রলোভনে পড়ে দেশের অর্ধশিক্ষিত সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত নিঃস্ব হচ্ছেন। তারা বাড়ির জমিজমা, গরু-ছাগল বিক্রি করে ডেসটিনির বিভিন্ন প্রকল্পে টাকা জমা দিচ্ছেন। কিন্তু তারা জানেন না, আদৌ তাদের ভবিষ্যৎ কি?

সূত্রমতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন ও ভিজিল্যান্স বিভাগের মাধ্যমে পরিচালিত হয় ওই বিশেষ পরিদর্শন ও তদন্ত কার্যক্রম। বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন ও ভিজিলেন্স বিভাগের দু’জন উপ-পরিচালক মোঃ জহির হোসেন ও রণজিৎ কুমার রায় ডেসিটিনি গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড কাকরাইলের অফিসে বিশেষ পরিদর্শনের মাধ্যমে এ তদন্ত কাজ পরিচালনা করেন। তারা তিনটি অভিযোগ সামনে রেখে তদন্ত করেন।

অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচলিত নীতিমালা অমান্য করে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি প্রকাশ্যে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতিষ্ঠানটি চড়া সুদে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে প্রতি মাসে কমপক্ষে ২০-২৫ কোটি টাকা মুনাফা করছে। দ্বিতীয় অভিযোগ হচ্ছে, সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা ৩৮ লাখ এজেন্টের মাধ্যমে মোটা অংকের কমিশন দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি তার ব্যবসার পরিধি বাড়াচ্ছে। তৃতীয় অভিযোগটি হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটি শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুরোধক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত কাজের সিদ্ধান্ত নেয়। পরিদর্শন টিম চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে পরিদর্শন ও তদন্ত কাজ পরিচালনা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে ওই প্রতিবেদন দাখিল করে।

ডেসটিনির ওপর পরিচালিত বিশেষ পরিদর্শন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঠনো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া তারা একদিকে যেমন আমানত সংগ্রহ করছে, অন্যদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না হয়েও শেয়ার বিক্রি করছে।

সমবায় অধিদফতর থেকে নিবন্ধন নেওয়া ওই প্রতিষ্ঠান জনগণের কাছ থেকে মাসে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা তুলে নিচ্ছে। ৪০ লাখ প্রতিনিধির মাধ্যমে ব্যাংকের মতো রীতিমতো আমানত সংগ্রহ করছে তারা। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না হয়েও বিক্রি করছে এর শেয়ার। তথাকথিত শেয়ার বিক্রি করেই প্রতিষ্ঠানটি হাতিয়ে নিয়েছে এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে যে তারল্য-সংকট রয়েছে, এর জন্য ডেসটিনির মতো মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটিগুলোর যোগসূত্র থাকতে পারে বলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, ব্যাংক বা পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ না করে সরাসরি জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করায় ব্যাংক ব্যবসা ও মূলধন বাজার ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়তে পারে।

সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বহুসংখ্যক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির যোগসূত্র থাকায় অনেক সাধারণ মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভের সভাপতি হলেন ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীন। এ ছাড়া উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মোহাম্মদ গোফরানুল হক, পরিচালক (অর্থ) মোহাম্মদ সাইদ-উর রহমান, পরিচালক (ক্রয়) মেজবাহ উদ্দীন, মোহাম্মদ হোসাইন প্রমুখ। এ ছাড়া ব্যবস্থাপনা ও উপদেষ্টা পর্ষদে তাঁদের আত্মীয়স্বজন রয়েছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেসটিনি অভিনব মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) পদ্ধতি অবলম্বন করছে। বিনিময়ে আমানত সংগ্রহকারীদের কমিশন দেওয়া হচ্ছে, যা অবৈধ ও অনৈতিক। প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়তে পারে এর সদস্য ৬৮ লাখ থেকে ৭০ লাখ মানুষ হতে পারেন প্রতারিত।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে কোনো ব্যয় না করলেও ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১৯৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে ব্যয় দেখিয়েছে ৬৫৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অথচ এর কোনো গবেষণাগার ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০১ সালের সমবায় সমিতি আইনের অজুহাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো আমানত সংগ্রহ করছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১১ সাল পর্যন্ত সংগ্রহ করেছে দুই হাজার কোটি টাকা। সমিতির শেয়ারহোল্ডারদের দায়দায়িত্ব তাদের পরিশোধিত মূলধনের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ নয়। তবে কখনো যদি অবসান ঘটাতে হয়, তখন পরিসম্পদে ঘাটতি থাকলে সদস্যরা নিজ নিজ শেয়ার অনুপাতে দায়ী থাকবেন। প্রতিষ্ঠানের লাখ লাখ শেয়ারহোল্ডার এ সম্পর্কে অবগত নন। প্রতিষ্ঠানটি শেয়ার মূলধন ও শেয়ারহোল্ডারের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়িয়ে অত্যন্ত সুচতুরভাবে এর দায়দেনার সঙ্গে লাখ লাখ মানুষকে সম্পৃক্ত করছে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

তদন্তে পাওয়া তথ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ডেসটিনির সদস্য হলেই ‘ডিস্ট্রিবিউটরস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর’ (ডিআইএন) ও ‘কাস্টমারস আইডেন্টিফিকেশন’ (সিআইডি) দেওয়া হয়। বর্তমানে সিআইডি নম্বরধারীর সংখ্যা ৬৮ থেকে ৭০ লাখ এবং ডিআইএন নম্বরধারী ৪০ থেকে ৪৫ লাখ। ডিআইএন নম্বরধারীরাই ডেসটিনি মাল্টিপারপাসের সদস্য।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ৪০টি শেয়ারের একটি লট ২০ হাজার টাকা করে বিক্রি করছে এই ডিআইএনরা। শেয়ার বিক্রি করতে পারলে ৫০০ পয়েন্ট ভ্যালু (পিভি) অর্জন করা যায়। আশ্চর্যজনক যে, পরিবেশক করা হয় ডেসটিনি গ্রুপের মূল প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের। আবার এই পরিবেশক হওয়াই ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির সদস্য হওয়ার পূর্বশর্ত। আবার এক লাখ টাকার মেয়াদি প্রকল্পে বিনিয়োগ করেও কোনো ব্যক্তি সদস্য হতে পারেন।

পাঁচ বছর আগেও প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন ৫০ কোটি টাকা ছিল বলে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে তা তিন হাজার কোটি টাকা, যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রচারিত লিফলেট অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি চলতি আমানত, সঞ্চয়ী আমানত, স্থায়ী আমানত, সাড়ে পাঁচ বছরে দ্বিগুণ আমানত প্রকল্প, মাসিক মুনাফাভিত্তিক আমানত প্রকল্প, শেয়ার মূলধন (যা সঞ্চয় আমানতেরই নামান্তর মাত্র) ইত্যাদি প্রকল্পের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির বেশিরভাগ আমানত প্রকল্প তফসিলি ব্যাংকগুলোর আমানত প্রকল্পের প্রায় অনুরূপ।

প্রতিষ্ঠানটি এভাবে ব্যাংকের মতো চলতি, স্থায়ী, সাড়ে পাঁচ বছরে দ্বিগুণ, মাসিক মুনাফা, শেয়ার মূলধন ইত্যাদি প্রকল্পের মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহ করছে। এর জন্য প্রশিক্ষিত মাঠকর্মী তথা কমিশন এজেন্টদের ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শহরের আনাচে-কানাচে ও প্রত্যন্ত গ্রামে।
এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার শেয়ার সংগ্রহও আমানতেরই নামান্তর। ২০০৬-০৭ সালে ৭১ লাখ, ২০০৭-০৮ সালে সাত কোটি দুই লাখ, ২০০৮-০৯ সালে ১৭ কোটি ৫৬ লাখ, ২০০৯-১০ সালে ২২২ কোটি ১৮ লাখ এবং ২০১০-১১ সালে প্রতিষ্ঠানটি ৫২২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা আমানত সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে এর মধ্যে ৪৯২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা অর্থাৎ ৯৪ শতাংশ আমানতই দীর্ঘমেয়াদি আমানত।

আমানতের বিপরীতে সুদ দেওয়া হয় সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশ। সমবায় আইন অনুযায়ী আয়ের টাকা যেহেতু করমুক্ত, তাই সুদের এতো উচ্চহার অস্বাভাবিক বলেও মন্তব্য করা হয়েছে প্রতিবেদনে। আমানত পরিশোধের দায়বদ্ধতা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি অতিরিক্ত শেয়ার ক্রয়ে জনগণকে প্রলুব্ধ করে তহবিল বাড়াচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিরীক্ষার বাধ্যবাধকতা না থাকায় যেকোনো মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভের মতো ডেসটিনিরও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা করেছে সমবায় অধিদফতর। এতেও অনেক ত্রুটি ধরা পড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরের শাখাওয়ারি সঞ্চয় সংগ্রহ, শেয়ার মূলধন, আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাবই নেই। ওই বছর অনুমোদনবিহীন ব্যয় হয়েছে ২১২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। সঞ্চয় ও শেয়ার মূলধন আহরণে কমিশন বাবদ ব্যয় হওয়া ২০০ কোটি টাকাকে গবেষণা ও উন্নয়ন ব্যয় দেখানো হয়েছে, যা হিসাবশাস্ত্রের রীতিনীতির পরিপন্থী।
স্থিতিপত্রে প্রাপ্তি ও প্রদানে কোনো মিল নেই এবং প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত চিত্র এতে প্রতিফলিত হয় না। প্রতিষ্ঠানটি জনগণের কাছ থেকে যে পরিমাণ সঞ্চয় ও শেয়ার মূলধন সংগ্রহ করেছে বলে নিরীক্ষা দলকে জানিয়েছে, তাও সঠিক নয়। বরং প্রকৃত সংগ্রহের পরিমাণ অনেক বেশি।

তদন্ত টিমের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ডেসটিনির মোট সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ২৩ কোটি ৯৯ লাখ ২৫ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এ সম্পদ ২০১০ সালের ৩০ জুন বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৫৭০ কোটি ৬১ লাখ ১৬ হাজার ৬৫২ টাকা এবং ২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর এটি আরও বেড়ে হয় তিন হাজার ১৮২ কোটি ৭১ লাখ ২২ হাজার ৮৩৬ টাকা। তিন বছরের ব্যবধানে মোট সম্পদ বেড়েছে তিন হাজার ১৫৮ কোটি ৭১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৯৩ টাকা। সম্পদ বৃদ্ধির এ হার হচ্ছে ১৩ হাজার ১৬৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ! একইভাবে আমানতের স্থিতি পাঁচ কোটি ৫২ লাখ ১৮ হাজার টাকা থেকে তিন বছরে বেড়ে হয়েছে ৬৫১ কোটি ৯৪ লাখ ৬৩ হাজার ৬৪৯ টাকা। তিন বছরে আমানত বেড়েছে ৬৩৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। বৃদ্ধির হার সাড়ে তিন হাজার শতাংশ!

শুধু তাই নয়, কোম্পানিটির শেয়ার মূলধনও তিন বছরের ব্যবধানে পাঁচ কোটি ৫২ লাখ ১৮ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৩৫৫ কোটি ৬৬ লাখ ২৬ হাজার টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে এ বৃদ্ধির হারকে ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনমতে, ডেসটিনি মাল্টিপারপাসের নামে জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থে মূলত জমি কেনা হচ্ছে। তবে জমির দলিল কার নামে হচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। আরও অর্থ নেওয়া হচ্ছে ডেসটিনি গ্রুপের ডেসটিনি ২০০০, ডেসটিনি ডায়মন্ড সিটিসহ ১৩টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানটি এখন মুনাফা অর্জন করছে মনে হলেও গবেষণা ও উন্নয়ন খাতের কমিশন সমন্বয় করলে এর নিট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪৪ কোটি টাকা। সে হিসাবে সমবায় সমিতির বিধিমালা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটিতে তারল্য ঘাটতি রয়েছে। এ তারল্য সংকটের কারণে যে কোনো সময় গ্রাহকরা তাদের আমানতের টাকা ফেরত নাও পেতে পারেন। আমানতকারীদের মধ্যেও দেখা দিতে পারে আস্থাহীনতার মনোভাব।

অন্যদিকে শেয়ার মূলধন ও সঞ্চয় আমানতের একটি অংশ কমিশন হিসেবে প্রদান করার কারণে প্রতিষ্ঠানের সংগৃহীত মূলধন হ্রাস পাওয়ায় সদস্যদের শেয়ারে বিনিয়োগকৃত অর্থ প্রতারিত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।

প্রতিবেদনটি পাঠানোর পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারীর কাছে একটি চিঠিও পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চিঠিতে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে তদন্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, ডেসটিনির বর্তমান প্রতারণামূলক ও অভিনব এমএলএম কার্যক্রম, উচ্চ হারে ও অযৌক্তিকভাবে মূলধন বৃদ্ধি এবং সংগ্রহীত আমানত ও মূলধন সুকৌশলে অন্যান্য কোম্পানিতে সরিয়ে নেওয়া ইত্যাদি অনিয়মের বিষয় আইনি কাঠামোর মধ্যে এনে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে এ ধরনের উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। বিস্তারিত তদন্ত করে ডেসটিনির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতেও সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি সমবায় সমিতি আইন, ২০০১ (সংশোধিত ২০০২) অধীনে নিবন্ধিত হওয়ায় তারা পরিদর্শন দলকে কিছু তথ্য সরবরাহ করলেও তাদের প্রতিষ্ঠানের জেনারেল লেজার, সদস্য রেজিস্টার, সঞ্চয় রেজিস্টার, লোন রেজিস্টার, বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক প্রতিবেদন, নমুনাভিত্তিক দৈনন্দিন লেনদেনের ভাউচার ইত্যাদি প্রদর্শনে অপারগতা প্রকাশ করে। এগুলোও উদ্বেগজনক বলেও মন্তব্য করেন পরিদর্শন ও তদন্ত টিম।

এছাড়া পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও রংপুর জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রশাসনসহ বিভিন্ন জনকে ম্যানেজ করে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করে তাদের টাকা দিয়ে ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশনের পরিচালকদের নামে বিঘার পর বিঘা জমি কেনারও অভিযোগ রয়েছে ডেসটিনির বিরুদ্ধে।

সূত্রের অভিযোগ, ডেসটিনির পদস্থ সবাই সীমাহীন আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করছেন। তাদের বেতনসহ সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় গ্রাহকদের টাকা থেকে। অথচ গ্রাহকরা জানেন না, তারা কবে জমির মালিক হবেন, কবে গাছের মালিক হবেন। আদৌ তাদের ভাগ্যে কি আছে তাও বলা মুশকিল। ডেসটিনি তাদের বিভিন্ন প্রকল্পের বড় বড় পদে এমন সব লোকজনকে নিয়োগ দিয়ে বসিয়ে রেখেছে, যাদের কারণে গ্রাহকরা অবিশ্বাসও করতে পারছেন না। বড় বড় পদে যাদের নিয়োগ দেওয়া আছে তারা আবার ব্যবহার হচ্ছেন কোম্পানির ঢাল হিসেবে।

অভিযোগে প্রকাশ, যখন যে সরকার ক্ষমতায়, সে সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজনকে বসানো হয় মোটা অংকের টাকা দিয়ে। ডেসটিনির উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, তাদের স্ত্রী-সন্তান এমনকি কাজের বুয়াও দেশের অভ্যন্তরে যে কোনো এয়ারলাইন্সে ফ্রি টিকিট পান বলে জানা গেছে। তারা দেশের যে কোনো স্থানে যেতে পারেন কোম্পানির টাকায়। তাদের জন্য বিদেশেও চিকিৎসা ফ্রি। যাতায়াত ভাড়াও কোম্পানির। এভাবে লাখ লাখ টাকা বেতন-ভাতা সুবিধা ছাড়াও ব্যাপক আর্থিক সুবিধা ভোগ করেন তারা।

ডেসটিনি গ্রাহকদের টাকায় উত্তরায় রয়েছে একজন পরিচালকের আলিশান বাড়ি ও ফ্ল্যাট। রয়েছে দামি গাড়ি।

সূত্র মতে, ট্রি প্লান্টেশনের কথা বলে গ্রাহকদের কাছ থেকে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রতিষ্ঠানটি এই বলে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে, ‘আমাদের বৃক্ষ রোপণ করা হয়ে গেছে। ১০ বছর পর সবাই লাভসহ টাকা ফেরত পাবেন।’ অথচ ডেসটিনির জমি কেনা থেকে শুরু করে বনায়ন না হওয়াসহ নানা অব্যবস্থাপনা সত্তে¡ও তারা টাকা নিচ্ছে। সে টাকা দিয়ে আবার পরিচালকদের নামেই জমি কেনা হচ্ছে। অনেক জায়গায় জমি কেনা হয়নি, কোথাও ভুয়া জমি কিনে গ্রাহকদের সান্ত্বনা দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অর্থ বাণিজ্য