দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বেশকিছু ইতিবাচক সূচকের আভাস মিলছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আতিউর রহমান অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, দেশের অর্থনীতি ইতিবাচক দিকে যাচ্ছে। তবে অর্থনীতির বেশকিছু সূচক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিগত বছরের তুলনায় বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই নেতিবাচক।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিগত আট মাসের ধাক্কা সামাল দিয়ে দেশর অর্থনীতি কতখানি ঘুরে দাঁড়াবে তা দেখার বিষয়। আর তাই দেশের অর্থনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ে বাংলানিউজ আয়োজন করেছে দুই পর্বের ধারাবাহিক। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসের অর্থনীতির সঙ্গে বিগত অর্থ বছরের একই সময়ের একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা করেছেন আমাদের ইকোনমিক করেসপন্ডেন্ট সাইদ আরমান। আজ তার শেষ পর্ব। এ পর্বে থাকছে কৃষি ঋণ, জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ, মূল্যস্ফীতি, মুদ্রা সরবরাহ পরিস্থিতি, অর্থ সরবরাহ, ঋণ পরিস্থিতি, শ্রেণিকৃত ঋণ, সরকারের ঋণ।
কৃষি খাত : চলতি অর্থ বছরের প্রথম সাত মাসে আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি খাতে ঋণ প্রবাহ কমেছে। অথচ এ খাতে নতুন নতুন পণ্য উৎপাদনের জন্য কৃষি ঋণ বিতরণের উচ্চতর প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর তফসিলি ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের ডেকে কৃষি খাতে ঋণ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১১-১২ অর্থবছরে ১৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি।
বিগত অর্থবছরে (২০১০-১১) এ খাতে ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। বিগত অর্থ বছরের একই সময়ে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিলো ১২ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। যেখানে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় ৯৭ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের (২০১১-১২) প্রথম সাত মাসে কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৬ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ৭ হাজার ১০৩ কোটি টাকা। যা অর্জিত লক্ষ্যমাত্রার ৪৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১২ সালের জানুয়ারিতে কৃষিঋণ বিতরণ ও আদায়ের পরিমাণ যথাক্রমে ৯৪৫ কোটি ও ৬৭১ কোটি টাকা।
জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ : ২০১১-১২ অর্থবছরের জানুয়ারি মাসে জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ ২১৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা হ্রাস পেয়েছে। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে যার পরিমাণ ৩২৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৬ মাসে জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা।
সরকারের ঋণ : ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ঋণ আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। চলতি অর্থবছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে সরকারের অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং খাত থেকে গৃহীত ঋণ বাজেটে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে। যার পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা।
সর্বশেষ মার্চে ব্যাংকিং খাত থেকে গৃহীত সরকারের ঋণ ১৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন, অর্থবছরের শেষ সময়ে সরকারের ধার আরও বাড়তে পারে।
মুদ্রা সরবরাহ, অর্থ ও ঋণ পরিস্থিতি : ২০১০-২০১১ অর্থবছরে দেশের রিজার্ভ মুদ্রার সরবরাহ বেড়েছিল ২১ দশমিক ৯ শতাংশ। আর বর্তমান অর্থবছরের (২০১১-২০১২) ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রিজার্ভ মুদ্রার সরবরাহ বেড়েছে মাত্র দশমিক ৫৪ শতাংশ।
একই সঙ্গে বিগত অর্থবছরে ব্যাপক অর্থ সরবরাহ বেড়েছে ২১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ৬ মাসে বেড়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
২০১০-১১ অর্থবছরে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ ২৭ দশমিক ৪১ শতাংশ বাড়লেও চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বেড়েছে ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ বৃদ্ধির হার ছিল ২৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। অথচ বর্তমান অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে তা বেড়েছে মাত্র ১০ দশমিক ২ শতাংশ।
তবে বিগত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জানুয়ারিতে রিজার্ভ মুদ্রা ১৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ, ব্যাপক অর্থ সরবরাহ ১৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ, মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ ২৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ ও বেসরকারি খাতে ঋণ ১৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ বেড়েছে।
মূল্য পরিস্থিতি : সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে গড় ভিত্তিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আর পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। গত অর্থবছরের আলোচ্য সময়ে এ হার ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ২১ ও ৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
তবে ধারণা করা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রসার মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির মূল কারণ।
শ্রেণিবিন্যাসিত ঋণ ও মূলধন পরিস্থিতি : বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর শ্রেণিবিন্যাসকৃত ঋণ কিছুটা কমেছে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের মোট ঋণের শ্রেণিকৃত ঋণের অংশ ছিল ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। যা ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। নিট ঋণে শ্রেণিকৃত নিট ঋণের অংশ গত বছরের ডিসেম্বরের চেয়ে কমেছে। বর্তমান অর্থবছরের ডিসেম্বরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দশমিক ৭০ শতাংশ। যা বিগত সময়ে ছিল ১ দশমিক ২৮ শতাংশ।
এ বিষয়ে তত্ত্বধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘সরকারের উচিৎ হবে প্রবৃদ্ধি যাতে ব্যাহত না হয়, তেমন নীতি গ্রহণ করে অর্থবছরের বাকি সময়টা চলা।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতিকে এক অংকে নিয়ে আসতে পারছে না। এটা চলতি অর্থবছরে আনতে পারবে বলেও মনে হয় না। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি এক অংক করার কথা বলা আছে।’