৩ নভেম্বর ২০১৫তে একবার শিরোনাম হয়েছিল আলিফ। অদম্য আলিফ তখন জেএসসি পরীক্ষাকেন্দ্র। বলা হয়েছিলো হাত-পা নেই, থামেনি চলা। আলিফ চলছে তার গতিতে। আজ আবার শিরোনামে সেই আলিফ। এবার শুধু কনুই দিয়ে লিখে জিপিএ-৫ অর্জন করলো সে। নিজের শরীরে অপূর্ণতা ভরিয়ে দিতে চায় সে তার মেধা আর ইচ্ছে শক্তি দিয়ে।
পুরো নাম আসিফ করিম আলিফ। জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী। তার দুই হাতের কব্জি ও দুই পায়ের হাটুর নিচের অংশ নেই। হাত-পা নেই বলে কিন্তু থেমে যায়নি আলিফের পথ চলা। জেএসসি পরীক্ষায় অন্য স্বাভাবিক ছাত্রর মতোই পরীক্ষা দিয়েছে সে। কারণ নিজেকে প্রতিবন্ধী ভেবে দমে থাকার পাত্র নয় আলিফ। দুই হাত দুই পা ছাড়াও যে এই সমাজে বেঁচে থাকা যায়, অসম্ভবকে সম্ভব করা যায় তা দেখিয়ে দিতে চায় সে। আর নিজের ইচ্ছাশক্তি ও স্বপ্নকে জয় করার আদম্য ইচ্ছা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।
বগুড়া পুলিশ লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৮ম শ্রেণি থেকে ৯ম শ্রেণিতে উঠলো আলিফ। বাবা মারা গেছেন তার ৩ বছর বয়স থাকতেই। একমাত্র সন্তানকে রেখে মা শাহনাজ আক্তার চাকরি করছেন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে। ছোট থেকেই নানা বাড়ি বগুড়া শহরের মালতিনগরে থাকে আলিফ। জন্মের পর আনন্দ করার চাইতে যাকে নিয়ে গোটা পরিবার শোক করেছে সেই আলিফ এখন ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে তার স্বপ্নের আকাশে। নিজেকে প্রতিবন্ধী ভেবে ঘরে বসে রাখার পাত্র নয় সে। কারণ ভবিষ্যতে আলিফ আর্কিটেক্ট হতে চায়। তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে যে কোনভাবেই।
কথা হয় সেই হাসোজ্জ্বল আলিফের সঙ্গে। জানালো নিজেকে নিয়ে হতাশ নয় সে। কারো করুনাও চায়না। প্রতিবন্ধিতাকে জয় করায় স্বপ্ন দেখে সে। পরীক্ষা শেষে কিংবা স্কুলে হুইল চেয়ারে নিয়া যাওয়া আসার দায়িত্ব পালন করেন তার নানা শহিদুর রহমান। জানালেন, তিনি নিজেও নাতির এই অগ্রযাত্রার পথিক হতে চান।
আলিফ জানায়, জিপিএ-৫ পাওয়া তার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। সে জানে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার মতো শারীরিক শক্তি না থাকলেও ইচ্ছে শক্তি রয়েছে তার। আর সেই ইচ্ছে শক্তিই আজ তাকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।
বগুড়া স্টাফ কোয়ার্টার প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময় বৃত্তি পেয়েছিল আলিফ। এরপর পুলিশ লাইন স্কুলে পড়ছে ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে। স্কুলের শিক্ষক, ছাত্র সকলেই আলিফের বন্ধু। সকলেই হাত পা ছাড়া এই যোদ্ধাকে নিজের মতো করে, অতি আপন করে নিয়েছে।
৮শ শ্রেণির শিক্ষক গোরাঙ্গ সাহা বলেন, ওর কারণে আমরা ৮ম শ্রেণির ক্লাস ২য় তলা থেকে নামিয়ে ১ম তলায় করেছি। পরীক্ষার সিট ফেলানো হয় নিচতলায়। ক্লাসে অন্যদের সঙ্গে বন্ধু ভাবাপন্ন আলিফ একদিন স্কুলে না এলে সবার মন খারাপ থাকে। সে যখন জেএসসি পরীক্ষা দেয় তখন আমাদের মনে কিছুটা উদ্বেগ থাকলেও শঙ্কা ছিলো না। কারণ আমরা জানি আর দশজনের মতোই এগিয়ে যাচ্ছে আলিফ। ফল প্রকাশের পর সে তার প্রমাণও দিয়েছে। সে আমাদের সকলের গর্ব।
আলিফ ফেসবুক ব্যবহার করে। তার আইডির নাম আসিফ করিম আলিফ। সেখানে তার বন্ধুর সংখ্যা ১৫শ। ক্লাসে অন্য স্বাভাবিক ছাত্রদের মতোই কম্পিউটার চালাতে, লিখতে পড়তে পারে সে।
বগুড়া পুলিশ লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহাদৎ আলম ঝুনু বলেন, আসিফ অত্যন্ত মেধাবী। আর এ কারণেই সে জিপিএ-৫ অর্জন করেছে। আমরা স্কুল থেকে তাকে সব রকম সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত আছি।