রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ মার্চ সোমবার সকাল ৬টা ২৭ মিনিটে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে মহান স্বাধীনতা শহীদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।
এসময় ৩ বাহিনী প্রধান, মন্ত্রীপরিষদ সদস্য, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সদস্য, বিদেশি কুটনীতিবিদ এবং পদকপ্রাপ্ত বিদেশি অতিথিরা তাদের সঙ্গে ছিলেন।
পুলিশ, র্যাব, সেনাসদস্য ও সাদা পোশাকের পুলিশ ছাড়াও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন স্মৃতিসৌধে কড়া নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী যখন মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের শ্রদ্ধা জানান, তখন স্মৃতিসৌধের সামনে হাজার হাজার সাধারণ জনতা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান ও শ্লোগান দিতে থাকেন।
এর আগে রাষ্ট্রপতি মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে রোববার দেওয়া এক বাণীতে বাংলাদেশের সব নাগরিককে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘বহু ত্যাগ-তিতীক্ষা এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় আমাদের মহান স্বাধীনতা। এ দিনে আমি সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের, যাঁদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। আমি পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে; যাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে- ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার লাল সূর্য।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি জাতীয় ৪ নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক-সমর্থকসহ সকল স্তরের জনগণকে, যাঁদের অসামান্য অবদান ও সাহসী ভূমিকা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করে। আমি স্মরণ করছি, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে যাঁরা স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে এদেশের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।‘
মহান স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গড়া উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন,’ সে লক্ষ্য অর্জনে সরকার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় জীবনে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ অবকাঠামো, যোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, নারীর ক্ষমতায়ন, যুব ও ক্রীড়া, মহিলা ও শিশু ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাদের সফল অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। তৈরি পোশাক, ফার্মাসিউটিক্যালস, সিরামিক, জাহাজ তৈরি শিল্পসহ বেসরকারি খাতে উন্নতি হয়েছে।‘
গণতন্ত্রের বিকাশ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ব্যাতীত সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পরমতসহিষ্ণুতা, সংযম এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গণতন্ত্র বিকাশের পূর্বশর্ত। জাতীয় জীবনে আমাদের আরো ধৈর্য, সংযম ও সহনশীলতার পাশাপাশি অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। জাতীয় সংসদকে পরিণত করতে হবে সকল আলোচনা ও সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দুতে।‘
সবশেষে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার ঘোষিত ‘ভিশন ২০২১’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে একটি তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গঠনে সবাই বাস্তব অবদান রাখবেন-এমন প্রত্যাশা করেন রাষ্ট্রপতি।
অপরদিকে, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে রোববার দেওয়া এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতা দিবসের এই দিনে দেশবাসীকে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও বাংলাদেশের উন্নয়ন বিরোধী যে কোনো অপতৎপরতা নস্যাৎ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বানও জানান। পাশাপাশি মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে দেশবাসী এবং প্রবাসী সব বাঙালিকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান।
তিনি তার বাণীতে বলেন, ‘২৬ মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনে এক গৌরবদীপ্ত দিন। এ মহান দিনে আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনকে, যাঁদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাই মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যাঁর অবিসংবাদিত নেতৃত্বে আমরা অর্জন করেছি প্রিয় স্বাধীনতা।‘
বাণীতে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় ৪ নেতা এবং অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, ভোগ করেছেন অমানসিক নির্যাতন, তাদের আমি আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। পাশাপাশি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে যেসব বিদেশি রাষ্ট্র, সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা দিয়েছেন তাঁদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানাই।‘
২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ’এই ঘোষণা টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টার ও তৎকালীন ইপিআর’র ওয়ারলেসের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।‘
তিনি বলেন, ’প্রতিটি জেলা ও মহকুমায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এই ঘোষণা ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রিকশায় মাইক লাগিয়ে তা প্রচার করেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এই ঘোষণা প্রচারিত হয়। তারই নির্দেশে পরিচালিত ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।‘
অনেক রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মহান স্বাধীনতা আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই অর্জনকে অর্থপূর্ণ করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে ধারণ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে দিনবদলের লক্ষ্যে, দুর্নীতি, সন্ত্রাসমুক্ত অসাম্প্রদায়িক ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে।
প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী গত ৩ বছরে দেশের কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলা, তথ্য-প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ, যোগাযোগসহ সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করেছে। সপরিবারে জাতির পিতা হত্যার রায় কার্যকর করার পর সরকার যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে, ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী, সাম্প্রদায়িক ও চিহ্নিত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি গণতন্ত্র ও সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে বানচাল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।‘
তিনি আরও বলেন, মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশকে একটি ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত আধুনিক ডিজিটাল ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ রূপে গড়ে তুলতে ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নের জন্য আমরা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি আশা করি, প্রতিটি বাঙালি ত্যাগ ও দেশেপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে স্ব স্ব অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে এই প্রচেষ্টায় সামিল হয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত করবেন।
সবশেষে সকলে মিলে জাতির পিতার আজন্ম লালিত স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।