অতিরিক্ত কার্বন নির্গমনের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য বাংলাদেশ যৎসামান্যই দায়ী। তবুও এর প্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি পরিবেশ ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ।
কার্বন নির্গমনের ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে যে, তাপমাত্রা বাড়ার প্রভাব পানির ওপর পড়ছে সবচেয়ে বেশি।
শনিবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তনে আয়োজিত ‘ওয়ার্কশপ ফর দ্যা জার্নাালিস্ট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ শিরোনামে কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
ইন্টারন্যাশনাল ক্লাইমেট চ্যাম্পিয়ন হাসান আবদুল্লাহ তৌহিদের সঞ্চালনায় দেশের বিভিন্ন প্রিন্ট, অনলাইন ও টেলিভিশন মিডিয়ার সাংবাদিকরা কর্মশালায় অংশ নেন।
কর্মশালায় দেশের বিশিষ্ট পরিবেশবিদ বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. আতিক রহমান, ডিপার্টমেন্ট অব এনভায়রনমেন্টের (ডিওই) ডেপুটি ডিরেক্টর মির্জা শওকত আলী, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ক্লাইমেট চেঞ্জ এবং হেলথ প্রমোশনের সমন্বয়ক ডা. ইকবাল কবির, বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের (বিসিএএস) রিসার্চ ফেলো গোলাম রাব্বানি, সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিপিআপডি) এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর শামসুদ দোহা এবং ক্রিস্টিয়ান এইডের জ্যেষ্ঠ প্রোগ্রাম কর্মকর্তা আশরাফুল আমিন তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
কর্মশালায় বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের (বিসিএএস) রিসার্স ফেলো গোলাম রাব্বানি জানান, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে কৃষি এবং পানির উৎসগুলো।
তিনি জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন কৃষকরা বলছেন এবারের আবহাওয়া কেমন যেন এলোমেলো। কেননা কখনও অতিবৃষ্টি আবার কখনো অনাবৃষ্টি, কখনো ক্ষরা আবার কখনো বন্যা-জলোচ্ছ্বাস দেখা দিচ্ছে। এ ধরনের বিরূপ আবহাওয়ার কারণে কৃষকের ঘরে থাকা ধানের বীজে একবার আবদা করলে দ্বিতীয়বার বীজ যোগানো কষ্টকর হয়ে যায়। অন্যদিকে, অসময়ে হঠাৎ বন্যা এসে কৃষকদের ফলন্ত ধানগাছও নষ্ট করে দিয়ে যায়। তখন আর নতুন করে ফসল লাগানোর উপায় থাকে না।
কৃষকরা তাদের বংশপরম্পরার অভিজ্ঞতা থেকে জানে, কোন সময়ে বন্যা হয়। সে অনুযায়ী তাদের প্রস্তুুতিও থাকে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনে তারা হারাচ্ছে কৃষি ফসল। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, গত ১৫০ বছরের তুলনায় বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের হার অনেক বেশি।
তিনি বলেন, সিডরের আগে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় আউশ ধানের উৎপাদন ছিল হেক্টরপ্রতি ৩৬০৬ মেট্রিক টন। সেখানে সিডরের পর দু’বছর গবেষণা করে দেখা গেছে, ওইসব এলাকায় এ ধানের উৎপাদন ১৮ ভাগ কমে এসেছে।
হেলথ প্রমোশনের সমন্বয়ক ডা. ইকবাল কবির জানান, একবিংশ শতাব্দীতে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অন্যতম ঝুঁকির মধ্যে পড়বে মানবস্বাস্থ্য। এর আগে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিকে কম গুরুত্ব দিয়ে দেখা হতো। তবে গবেষণায় এটিই এখন প্রমাণিত যে, জলবায়ু পরিবর্তনে কারণে স্বাস্থ্য সমস্যা প্রকট হচ্ছে। এখন থেকে পতঙ্গবাহিত রোগের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। এছাড়া ডায়রিয়া, কিডনির সমস্যা, একলামসিয়া, ম্যালেরিয়া, গর্ভধারণজনিত সমস্যাসহ নানান ধরনের রোগ ব্যাপক আকার ধারণ করবে।
ক্রিস্টিয়ান এইড-এর জ্যেষ্ঠ প্রোগ্রাম কর্মকর্তা আশরাফুল আমিন জানান, কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন গ্যাস এবং সিএফসি গ্যাস পৃথিবীতে কার্বন ধরে রাখছে। সূর্য থেকে শর্টওয়েভে আলট্রাভায়োলেট রশ্মির মাধ্যমে পৃথিবীতে তাপ এলেও এখান থেকে লং ওয়েভে ইনফ্রারেট রশ্মির মাধ্যমে তাপ যেতে পারে না। ফলে পৃথিবী তাপ ধরে রাখে।
আর এ কারণে পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে গলে যাচ্ছে বরফরাশি।
একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাপ বাড়ালে পানির আয়তন বাড়ে, তাই তাপমাত্রা বেড়ে সমুদ্র পৃষ্ঠেও পানির আয়তন বাড়ছে। এ কারণে এক সময় উপকূলীয় এলাকাগুলো ডুবে যাবে। এভাবে তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড় তৈরি হবে। এর ধ্বংসাত্মক মাত্রা অকে বেশি থাকবে বলে জানান আশরাফুল আমিন।
তবে আশার কথাও শোনান কর্মশালায় অংশ নেওয়া পরিবেশবিদরা।
এর মধ্যে বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. আতিক রহমান জানান, সারা বিশ্বের মধ্যে আমরা মাত্র শূন্য দশমিক পনেরো ভাগ কার্বন নির্গমন করি যেখানে যুক্তরাষ্ট্র করে ৩৬ ভাগ। এদিক থেকে যুক্তরাজ্য, রাশিয়াও পিছিয়ে নেই। এমনকি উন্নয়নশীল দেশ ভারত ও চীনের কার্বন নির্গমনের মাত্রাও কয়েক গুণ বেড়েছে।
অথচ আমরাই রয়েছি সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে। যার কারণে আজ আমরা লড়ছি ক্ষতিপূরণের আশায়। পাচ্ছিও, তবে যৎসামান্য। এজন্য আমাদের নেগোসিয়েশন চলছে। বিশ্বের অনেক দেশই তাদের ক্ষতিপূরণ দাবি করছে। আমাদের সরকারও আমাদের অবস্থান তুলে ধরে সোচ্চারভাবে ক্ষতিপূরণের দাবি তুলেছে।
তিনি আরও জানান, আমরা এখন ক্ষতিপূরণের আশায় বেশি কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলোর বিরুদ্ধে কেস ফাইল করতে যাচ্ছি। কেস করার জন্য যেখানে আমরা এতোদিন কোনো ‘কজাল রিলেশনশিপ’ পাচ্ছিলাম না, সেখানে এখন বিভিন্ন দেশের বড় বড় আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। একটি ‘কজাল রিলেশন’ আমরা খুঁজে পেয়েছি সেটা হলো শিল্পায়ন। তবে বিষয়টিকে আরও যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।
তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেন, এখন সময় এসেছে তরুণদের এসব বিষয়ে জানা এবং উন্নত বিশ্ব আমাদের সঙ্গে যে ইনজাস্টিস করছে সেখানে লড়া। তাহলে আমরা বিচার পাবো এবং ক্ষতি হয়তো কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারবো।
ডিপার্টমেন্ট অব এনভায়রনমেন্টে (ডিওই) ডেপুটি ডিরেক্টর মির্জা শওকত আলী জানা, বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী যেসব সম্মেলন হচ্ছে সেখানেও আমাদের দাবিগুলো জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখানে কিওটো প্রটোকল অনুযায়ী বলা হয়েছিল ২০০৮ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে পাঁচ ভাগ কার্বন নির্গনমের হার কমাতে হবে।
একবিংশ শতাব্দীতে তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি না বাড়ানোর জন্য এমনকি উন্নত দেশগুলো থেকে ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ কার্বন কম নির্গমনের কথা বলা হয়েছে। তবে এসব উন্নত দেশ এই চুক্তিতে এখনও স্বাক্ষর করেনি। এ বিষয়ে আলোচনা চলছে এবং পরিবেশ বিষয়ে সম্মেলনগুলোতে পৃথিবীর প্রায় সবক’টি সংস্থা অংশ নেয় তাদের সমস্যা তুলে ধরার জন্য।
সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিপিআপডি) এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর শামসুদ দোহা বলেন, ‘পৃথিবীকে নিরাপদ ও বাসযোগ্য করার জন্য কার্বন কমানোর বিকল্প নেই। তাই কার্বন কমাতে এবং ক্ষতিপূরণ দিতে আর্থিক সহায়তা দেবে সবচেয়ে কার্বন উৎপাদনকারী উন্নত দেশগুলো। আর এ কথা স্পষ্ট উল্লেখ আছে ইউএনএফসিসিসি এবং কিওটো প্রোটোকলে।’
সেখানে বলা হয়েছে, উন্নত দেশগুলো তাদের জিডিপির শূন্য দশমিক সাত ভাগ দুর্গত দেশগুলোকে দেবে দারিদ্র্য দূর করার জন্য। আর জলবায়ুর কারণে এর চেয়েও বেশি টাকা দেবে। তবে এটি ঋণ নয়, এইড হিসেবে।
এ লক্ষ্যে এখন চলছে কার্বন ট্রেডিং। যেমন উন্নত দেশগুলো তাদের ইন্ডাস্ট্রি কমাতে পারছে না ব্যবসায়ীদের চাপে পড়ে। এজন্য তারা আমাদের মতো দেশগুলো কার্বনের আরও পরিমাণ কমাতে কার্বন ট্রেড করছে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের ইটের ভাটাগুলোতে যাতে কার্বন কম নির্গত হয় এজন্য তারা উন্নত প্রযুক্তি দিচ্ছে। চুলায় খড়ি পোড়নোর পরিবর্তে উন্নত চুলা দিচ্ছে যাতে আরও কম কার্বন নির্গত হয়।
বক্তারা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, সরকারের চেষ্টা এবং নেগোসিয়েশন পর্যায়ে আমাদের দাবিগুলো জোরালো হচ্ছে। তবে জনগণের কাছে সবচেয়ে আগে তথ্যটি দিতে পারেন ও তাদের সমস্যা তুলে ধরতে পারেন সাংবাদিকরা। সেজন্য সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে এ কর্মশালা- যাতে তারা গবেষকদের গবেষণার সমন্বয় ও জনগণের অবস্থান তুলে ধরতে পারেন।