অনিয়ন্ত্রিত ব্যাংক সুদে দিশেহারা উদ্যোক্তারা

অনিয়ন্ত্রিত ব্যাংক সুদে দিশেহারা উদ্যোক্তারা

ব্যাংক ঋণের অনিয়ন্ত্রিত সুদ এবং সেবার নামে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। অনেকের ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধের উপক্রম। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, উচ্চ সুদের ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে যাবে। এ অবস্থায় সুদের হার নির্ধারণে প্রয়োজন একটি মাস্টার প্লান।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশ অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) সূত্র জানায়, সম্প্রতি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যবসায়িক ঋণের সুদ ১২ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ১৮ দশমিক ৫ ভাগ করা হয়েছে। মাত্র ১০০ জন ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে বলে ব্যাংকের তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সুদ বাড়ানো হয়েছে আর ব্যবসায়ীরাও ঋণ প‍াচ্ছেন না।

সূত্র আরো জানায়, শিল্পসহ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ঊর্ধ্বমুখী সুদের হার নিয়ন্ত্রণের জন্য অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) গত ৭ ফেব্রুয়ারি এক সভায় স্থায়ী আমানতের উপর সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ঋণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদের হার নির্ধারণ করে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে তা কার্যকরের সিদ্ধান্ত হলেও ব্যাংকগুলো তা মানছে না।

ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সুদের জন্য কোনো নীতিমালা না থাকায় প্রত্যেকটি ব্যাংক ইচ্ছা মতো সুদ নিচ্ছে। এছাড়া মাঝে মধ্যেই তা বাড়ানো হচ্ছে। ফলে ব্যবসা নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশেনের সভাপতি মেজর (অব.) জসিম উদ্দিন জানান, তিনি একটি ব্যাংক থেকে আড়াই কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ সুদে। তবে এই সুদের হার যেকোনো সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বাড়াতে পারে বলে ঋণপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পাইকারী ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম জানান, প্রায় দু’ মাস আগে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১৫ দশমিক ৫ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ১৮ দশমিক ৫ ভাগ করার জন্য চিঠি দিয়েছে।

তিনি বলেন, নতুন নতুন ব্যাংক হচ্ছে, এরপরেও সুদের হার নিয়ন্ত্রণ না হলে ব্যবসা টিকবে না। আর ব্যবসা করতে গেলে দ্রব্যের দাম বাড়বে। প্রভাব পড়বে জনসাধারণের উপর।

উদ্যোক্তারা বলছেন, সুদের উচ্চ হারে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে। বাংলাদেশ স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলি জামান বলেন, দেশের শিল্প-বাণিজ্যের শতকরা ৮০ ভাগ এসএমই খাতের অন্তর্ভুক্ত। তাই এসএমই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে অবিলম্বে ব্যাংক সুদের উচ্চ হার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

এফবিসিসিআই-এর সভাপতি একে আজাদ ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি জানান, চলতি ঋণ ছাড়াও পূর্বের ঋণের উপরও অতিরিক্ত সুদ নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় উদ্যোক্তারা সমস্যায় পড়ছেন।

এদিকে ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের কারণে জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)- এর সভাপতি কাজী ফারুক।

তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো সিন্ডিকেট করে উচ্চ সুদের জন্য যে চাপ সৃষ্টি করছে তা থেকে মুক্ত হতে না পারলে শিল্প-কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুদের হার বাড়ালে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা প্রয়োজন মতো ঋণ নিতে পারবেন না। এতে শিল্পখাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের সুদের উচ্চ হারের প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে।

এ ব্যাপারে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক (এসএমই বিভাগ) সুকমল সিং চৌধুরী জানান, সুদের উচ্চ হার সমর্থন করা হবে না। হার নমনীয় রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

ব্যাংক এবং উদ্যোক্তাদের মধ্যে পারফেক্ট প্রতিযোগিতা হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, উদ্যোক্তারা সচেতন হলে ভোগান্তি কিছুটা কমবে। এসএমই খাতের বিকাশ না হলে অর্থনীতির বিকাশ হবে না। গত বছর ৩ ল‍াখ ১৯ হাজার উদ্যোক্তাকে ঋণ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ব্যাংকের উচ্চ সুদের কারণে যেন কোনো শিল্পের ক্ষতি না হয় সে দিকে ব্যাংকগুলোকে খেয়াল রাখা উচিত। সুদ সিঙ্গেল ডিজিট (১০- এর নিচে) হলে প্রবৃদ্ধি ডাবল ডিজিট হবে।

শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ব্যাংক-বীমাসহ অন্যান্য অবকাঠামো সুবিধা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে একটি সমন্বিত নীতি তৈরি করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

অর্থ বাণিজ্য