প্যারিসের সন্ত্রাস এক টেবিলে বসিয়ে দিল বারাক ওবামা এবং ভ্লাদিমির পুতিনকে। রবিবার তুরস্কে জি-২০ সম্মেলনের ফাঁকে মার্কিন এবং রুশ প্রেসিডেন্ট আলাদা করে আধ ঘণ্টারও বেশি সময় কথা বলেন। তার একটু আগেই জি-২০ মঞ্চ থেকে ওবামা ঘোষণা করেছেন, আইএসের বিরুদ্ধে চতুর্গুণ শক্তি নিয়ে ঝাঁপাবে তাঁর দেশ। পুতিনের সঙ্গে আইএস হামলা এবং সিরিয়া সঙ্কট নিয়েই আলোচনা হয় তাঁর।
প্যারিসে আত্মঘাতী হানার পরেই প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ ঘোষণা করেছিলেন, বর্বরদের প্রতি আর কোনও রকম দয়ামায়া দেখাবে না ফ্রান্স। এই রণহুঙ্কার আইএস দমন অভিযানে পশ্চিমী শক্তিগুলির অবস্থানে আমূল পরিবর্তনের ইঙ্গিত কি না, সেটা আর কিছু দিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। তার আগে রবিবার ওবামা-পুতিন বৈঠক আইএসের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জোটের সম্ভাবনা কিছুটা হলেও উস্কে দিল।
পুতিন গোড়া থেকেই আইএস-এর বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযান চালানোর পক্ষপাতী। সেপ্টেম্বর মাস থেকে সিরিয়ার বিমানহানা শুরু করেছে রাশিয়া। জবাবে গত ৩১ অক্টোবরই একটি যাত্রিবাহী রুশ বিমানে আঘাত হানে আইএস। সিরিয়া-নীতি নিয়ে আমেরিকা এবং ইউরোপের সঙ্গে পুতিনের স্পষ্ট বিরোধ আছে। এ দিন ওবামার সঙ্গে বৈঠকের পরেও সেই বিরোধ মেটেনি বলে ক্রেমলিনের খবর। তবে ওবামা এবং পুতিন একমত হয়েছেন যে, সিরিয়ায় অবিলম্বে সংঘর্ষবিরতি প্রয়োজন। তার পরে রাষ্ট্রপুঞ্জের মধ্যস্থতায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ এবং বিরোধীদের মধ্যে শান্তি-আলোচনা শুরু হওয়া দরকার। আর অন্য দিকে আইএস-কে সমূলে বিনাশ করা ছাড়া উপায় নেই।
এর মধ্যে সোমবারই আবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে পুতিনের বৈঠক আছে। সেখানেও সিরিয়া নিয়ে পুতিনের সঙ্গে পশ্চিমী দুনিয়ার দূরত্ব কমানোর চেষ্টা হবে বলে কূটনীতিক মহলের অনুমান। এ বার ক্যামেরন যদি পুতিনকে অনুরোধ করে আসাদকে ভোটে দাঁড় করানোর পরিকল্পনা ত্যাগ করাতে পারেন, তা হলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাশিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিরিয়ায় ঝাঁপাতেও পারে পশ্চিমী দেশগুলি।
সিরিয়ায় পুতিনের সঙ্গে অন্যদের বিরোধ আসাদকে ঘিরেই। আগামী বছরে আসাদকে ভোটে দাঁড় করানোর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন পুতিন। কিন্তু আমেরিকা এবং ইউরোপ আসাদকে স্বৈরতন্ত্রী এবং যুদ্ধাপরাধী বলে মনে করে। আইএস-এর বিরুদ্ধে তাদের পুরোদমে অভিযানে না-নামার পিছনে এই মনোভাবই অনেকটা দায়ী। কারণ পশ্চিমী শক্তিগুলি চায় না, আসাদের হাত কোনও ভাবে শক্ত হোক। ওবামা এখনও অবধি ইরাক এবং সিরিয়ায় স্পেশাল ফোর্সের কিছু ছোট দল পাঠিয়েছেন। তারা সিরিয়ার বিদ্রোহী শক্তি এবং কুর্দদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। সিরিয়া নিয়ে এই দোটানার ফাঁক গলেই আইএস ক্রমশ তার শক্তি বাড়াচ্ছে।
কিন্তু এখন আর হাত গুটিয়ে থাকার উপায় যে নেই, সেটা আন্তর্জাতিক মহল বুঝতে পারছে। আমেরিকার ভিতরে ওবামার উপরে চাপ তৈরি হচ্ছে। তাঁর ধৈর্য ধরে এগোনোর নীতি প্রশ্নের মুখে পড়ছে। ভোটের আগের বছরে বিরোধী রিপাবলিকানরা সুর চড়াচ্ছে। শুক্রবার সকালেই ওবামা দাবি করেছিলেন, আইএস-এর শক্তি নতুন করে আর বাড়ছে না। সেদিন রাতেই প্যারিসের ঘটনা তাঁর সেই বিশ্বাস নাড়িয়ে দিয়েছে। অন্য দিকে পুতিনের গলায় জোর বাড়ছে। এর আগে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভার অধিবেশনে তিনি সিরিয়া নীতি নিয়ে পশ্চিমী দুনিয়ার সমালোচনা করেছিলেন। সে দিনও ম্রিয়মান শুনিয়েছিল ওবামার যুক্তি।
আর প্যারিসের ঘটনার পরে পুতিন তাঁর কূটনৈতিক জমি আরও শক্ত করে ফেলেছেন। সিরিয়াতে আমেরিকা এবং ইউরোপ যে ‘ভুল’ করেছে, সেটা প্রমাণ করার বড় সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, আইএস-এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক শক্তিকে যে একযোগেই লড়তে হবে, প্যারিস তা দেখিয়ে দিল।
বস্তুত শুক্রবার রাতে প্যারিস যে সন্ত্রাসের সাক্ষী হয়েছে, তার সঙ্গে দু-দু’টো আন্তর্জাতিক সঙ্কটের যোগ রয়েছে। প্রথমটা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং আইএস-বিরোধী অভিযান। দ্বিতীয়টা এরই পরিণামে উদ্ভূত শরণার্থী সঙ্কট। প্যারিস হামলা ‘সিরিয়ার বদলা’ বলে দাবি করেছে আইএস জঙ্গিরাই। আর তাদের মধ্যে অন্তত দু’জন শরণার্থীদের ভিড়ে মিশেই ও-দেশে ঢুকেছিল বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করছেন গোয়েন্দারা। সুতরাং আইএসকে ঠেকাতে কী করা হবে এবং শরণার্থীদের ব্যাপারে নীতি কী হবে, এই দু’টো প্রশ্ন নিয়েই পশ্চিমী দেশগুলিকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। বিভিন্ন মহলে দাবি উঠতে শুরু করেছে, শরণার্থীদের নির্বিচারে ঢুকতে দেওয়া মানে নিজের দেশের সর্বনাশ ডেকে আনা।
এমনটা হতে পারে আঁচ করে শনিবারই জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল বলেছিলেন, প্যারিসে হামলা হয়েছে বলে শরণার্থীদের নাকের উপরে দরজা বন্ধ করে দেওয়া যেন না হয়। কিন্তু নিহত জঙ্গিদের কাছে সিরিয়ার পাসপোর্ট পাওয়ার খবর সামনে আসার পরে মের্কেল ঘরের মাটিতেই চাপে পড়ে গিয়েছেন। ব্যাভেরিয়ার অর্থমন্ত্রী স্পষ্ট বলে দিচ্ছেন, ‘‘প্যারিসের ঘটনা সব কিছু বদলে দিয়েছে। এ ভাবে চলতে পারে না।’’ হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভাকিয়া আগেই বলেছিল, শরণার্থীদের জন্য দরজা খুলবে না। এখন পোল্যান্ডও সেই দলে যোগ দিচ্ছে। সোমবার পোল্যান্ডে নতুন সরকার কাজ শুরু করবে। তারা আগেই জানিয়ে রেখেছে, প্যারিস সন্ত্রাসের পরে অবস্থা বদলে গিয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না-হলে এখন আর শরণার্থীদের গ্রহণ করার প্রশ্ন নেই। অবস্থা সামাল দিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান জাঁ-ক্লদ জুঁকা এ দিন বলেন, ‘‘সব মানুষকে এক করে দেখা চলবে না। যে জঙ্গি, সে আসলে শরণার্থী নয়। পরিস্থিতি কঠিন ঠিকই। কিন্তু তার জন্য শরণার্থী-নীতি বদল করা দরকার বলে মনে করি না।’’
কিন্তু প্রশ্ন হল, এ ভাবে আর কত দিন? ইউরোপীয় ইউনিয়নের হিসেবই বলছে, আগামী বছরও যদি সিরিয়ায় শান্তি না-ফেরে তা হলে আরও অন্তত ৩০ লক্ষ উদ্বাস্তু ইউরোপে আসবেন। সিরিয়া থেকে ইউরোপে ঢোকার জন্য জনস্রোত তুরস্কের উপর দিয়ে যাচ্ছে। সে দেশে এখনই ২০ লক্ষ শরণার্থী এসেছেন। বাড়তি আর্থিক অনুদান দাবি করে তুরস্ক চাইছে, কোন দেশ কত উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দেবে, তার একটা নির্দিষ্ট কোটা তৈরি করে দেওয়া হোক। তুরস্কেও আইএস ইতিমধ্যেই দু-দু’টি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এ দিনও সীমান্ত লাগোয়া একটি শহরে শরীরে বিস্ফোরক বেঁধে নিজেকে উড়িয়ে দিয়েছে এক জঙ্গি।
গোটা ইউরোপ জুড়ে সীমান্ত নিয়ে আতঙ্ক তাই চড়চড় করে বাড়ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি দেশের মধ্যে ২২টি দেশ যে শেনজেন-ব্যবস্থা মেনে চলে, সেটাও প্রশ্নের মুখে পড়ছে। শেনজেন-ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে এক দেশ থেকে অন্য দেশ যেতে পাসপোর্ট লাগে না। বিদেশিরা শেনজেন ভিসা পেলে ওই ২২টি দেশেই যাতায়াতের সুযোগ পান। সুইৎজারল্যান্ড বা নরওয়ের মতো দেশ ইইউ-এর সদস্য না হলেও শেনজেন-এর অন্তর্ভুক্ত। আবার ব্রিটেন ইইউ-এ থাকলেও শেনজেনে নেই। এখন বিভিন্ন মহলের অভিযোগ, শেনজেন-এর সুযোগ নিয়েই মুক্ত সীমান্তে জঙ্গিদের
অবাধ গতিবিধি এবং অস্ত্র পাচার হু হু করে বাড়ছে।
শরণার্থী সঙ্কটে দীর্ঘমেয়াদি বিকল্প খোঁজার পক্ষপাতী ক্যামেরনও। তিনি চান, সিরিয়া সীমান্তেই উদ্বাস্তুদের জন্য শিবির তৈরি করে তাদের রোজগার এবং শিশুদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা হোক। ব্রিটেন এখনও অবধি ২০ হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দেবে বলেছে। মঙ্গলবার শরণার্থীদের প্রথম দলটি ব্রিটেনে ঢুকবে। এখনও অবধি সেই সূচি অবশ্য পরিবর্তন করা হয়নি। তার আগে এক দিকে একযোগে লড়াই নিয়ে দ্বিধা, অন্য দিকে উদ্বাস্তুদের আশ্রয় নিয়ে দোলাচল, আক্ষরিক অর্থেই সঙ্কটে ইউরোপ। প্যারিসের রক্তস্রোত আয়লান কুর্দির স্মৃতিকে ফিকে করে দেয় কি না, সেটাই দেখার।