নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের সম্পদের তথ্য জানতে সম্পদ বিবরণীর নোটিশ জারি করতে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক সূত্র জানিয়েছে, কমিশনের অনুমতির পর দু-এক দিনের মধ্যে এ নোটিশ জারি করা হবে। এ ছাড়া কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার পর তাঁকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন না করায় পুলিশের বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা হচ্ছে। রিমান্ডে নেওয়া যাবে কি যাবে না—সে বিষয়েও বিতর্ক হচ্ছে। এর মধ্যেই দুদক তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ ও সম্পদ বিবরণীর নোটিশ জারির সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পলাতক থাকার কারণে আমরা নূর হোসেনকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারিনি। এ কারণে আমাদের অনুসন্ধান কাজেও স্থবিরতা ছিল। তাঁকে এখন দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এখন আইন অনুযায়ী কাজ করবেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা।’
গত বছরের ২৯ মে নূর হোসেনের সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। সূত্রমতে, প্রাথমিক অনুসন্ধানে তাঁর নামে-বেনামে প্রায় ৮ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের খোঁজ পায় সংস্থাটি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা মামলার সুপারিশ করে কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেন। কিন্তু কমিশন মামলার অনুমতি দেয়নি। দুদকের উচ্চপর্যায়ের সূত্রটি জানিয়েছে, নূর হোসেনকে কোনো ধরনের সম্পদ বিবরণী নোটিশ দেওয়া কিংবা জিজ্ঞাসাবাদ করতে না পারায় মামলার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
চলতি মাসের ১২ তারিখ নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার পর তাঁর সম্পদের তথ্য জানতে সম্পদ বিবরণীর নোটিশ জারি এবং জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি নিয়ে দুদকে আলোচনা শুরু হয়। দুদক কর্মকর্তাদের মতে, সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারি এবং জিজ্ঞাসাবাদে আইনগত কোনো বাধা নেই। তাই অনুসন্ধান কর্মকর্তা সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারির অনুমতি চেয়ে কমিশনে আবেদন করেছেন। অনুমতি পেলে দু-এক দিনের মধ্যে নোটিশ জারি করা হবে বলে সূত্রটি জানায়।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, নূর হোসেনের সম্পদ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাঁর প্রায় ৮ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে সংস্থাটি। নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং অনুসন্ধানে আরও সম্পদের খোঁজ পাওয়া যেতে পারে বলে তাদের ধারণা। আয়কর ফাইল অনুসারে নূর হোসেনের সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৭ লাখ টাকা।
গত বছরের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনার পরে ভারতে পালিয়ে যান নূর হোসেন। ওই বছরের ১৪ জুন কলকাতার বাগুইআটিতে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ভারতে অবস্থানের মামলা হয়। গত মাসে ভারত সরকার সেই মামলা প্রত্যাহার করে নিলে নূর হোসেনের দেশে ফেরার পথ সুগম হয়।
সে ধারাবাহিকতায় গত ১২ নভেম্বর বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এর পরের দিন আদালতের নির্দেশে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় তাঁকে। তবে হত্যার শিকার ব্যক্তিদের স্বজনেরা রিমান্ডে না নিয়ে নূর হোসেনকে কারাগারে পাঠানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁদের বক্তব্য, এখনো সাত খুনের ঘটনার পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতা চিহ্নিত হয়নি। তবে পুলিশ বলছে, তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দিয়ে দেওয়ায় এই মামলায় তাঁকে রিমান্ডে নেওয়ার সুযোগ নেই।
ট্রাকচালকের সহকারী হিসেবে জীবন শুরু করা নূর হোসেন ১৯৯২ সালে বিএনপির সাবেক সাংসদ গিয়াসউদ্দিনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে যোগ দেন বিএনপিতে। সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি শামীম ওসমানের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। বাংলাদেশ ট্রাকচালক শ্রমিক ইউনিয়ন কাঁচপুর শাখার সভাপতি হন। তাঁর বিরুদ্ধে দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১৩টি মামলা হয়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁকে ধরিয়ে দিতে ইন্টারপোলে রেড নোটিশও পাঠানো হয়। ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের পর তিনি এলাকায় ফেরেন। পরে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে তিনি ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। কাঁচপুরে শীতলক্ষ্যা নদী দখল করে বালু-পাথরের ব্যবসা, উচ্ছেদে বাধা, পরিবহনে চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে বারবার আলোচনায় আসেন তিনি।