পুরো গ্যালারি ফাঁকা। গ্যালারির হাজার হাজার দর্শক আশ্রয় নিয়েছেন সবুজ মাঠে। যে মাঠে ফুটবলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসেছিলেন তারা। দেখতে এসেছিলেন ফ্রান্স বনাম জার্মানি প্রীতি ম্যাচ। তাতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে ২-০ গোলে হারানোর আনন্দও এনে দিয়েছে তাদের জাতীয় দল। কিন্তু সেই জয়ের আনন্দ ম্লান হয়ে গেল নিমেষেই। পুরো নগর যে ততক্ষণে পরিণত হয়েছে আতঙ্কের এক জনপদে!
প্যারিস জুড়ে স্মরণকালের ভয়াবহ পরিকল্পিত সন্ত্রাসী আক্রমণ চালানো হয়েছে। মূল আক্রমণের লক্ষ্য ছিল প্যারিসের কেন্দ্রস্থলের একটি কনসার্ট হল। কেবল সেখানেই কমপক্ষে ১০০ জনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সন্ত্রাসীদের অন্যান্য আক্রমণের লক্ষ্যস্থলের মধ্যে ছিল প্যারিসের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম স্টাডে ডি ফ্রান্সও। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁতেও আক্রমণ চালানো হয়েছে।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে ফ্রান্স এরই মধ্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা দিয়েছে। প্যারিসে নামানো হয়েছে সেনাবাহিনী। সন্ত্রাসীরা বন্দুক ও বোমা নিয়ে এই আক্রমণ চালায়। এর মধ্যে আত্মঘাতী বোমা হামলা ছিল বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
আত্মঘাতী বোমা হামলার লক্ষ্য ছিল স্টাডে ডি ফ্রান্স। অবশ্য স্টেডিয়ামের ভেতরে হামলাকারীরা ঢুকতে পারেনি। প্রথম বোমা হামলা চালানো হয় স্টেডিয়ামের একেবারে কাছে। ম্যাচের ১৭ মিনিটের মাথায়ই প্রথম বিকট শব্দে একটি বোমার গর্জন শোনা যায়। কেউ বুঝে উঠতে পারেনি শব্দের কারণ ও উৎস। দর্শকেরা আতশবাজি ধরনের কিছুর আওয়াজ ভেবে সাদরেই উল্লাস করে সেই আওয়াজকে এক রকম স্বাগতই জানান।
তখনো তারা জানতে পারেননি, কী ভয়াবহ তাণ্ডব শুরু হতে চলেছে প্যারিস জুড়ে। সংশয় আর আতঙ্ক নিয়েই স্বাগতিক দলের ২-০ গোলের জয়ে শেষ হয় ম্যাচ। গোল করেন অলিভিয়ের জিরু ও গিগন্যাক। উৎসবের আমেজ নিয়ে শুরু হওয়া সন্ধ্যাটি নিমেষেই পরিণত হয় কী ভীষণ আতঙ্কের রাতে!
২০ মিনিটের মাথায় আবারও বিকট আওয়াজ। এবার গ্যালারিতে আতঙ্কের মৃদু স্রোত বইতে শুরু করে। মাঠে অবশ্য খেলোয়াড়দের পুরো মনোযোগ ফুটবলে। কেবল সেই ২২ জন বাদে বাকিরা ততক্ষণে বুঝে গেছে কিছু একটা হচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে চক্কর দিতে থাকে হেলিকপ্টারও।
স্টেডিয়ামের সাউন্ড সিস্টেমে তখনো কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। কিন্তু ম্যাচটি দেখতে আসা রাষ্ট্রপতি ফ্রাসোয়া ওঁলাদ দ্রুত স্টেডিয়াম ত্যাগ করেন। মাঠে ম্যাচ গড়াতে থাকে, আর দর্শকদের মুঠোফোনে আসতে থাকে একের পর এক দুঃসংবাদের বার্তা।
৯০ মিনিটে শেষ বাঁশি বাজে। বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে স্মরণীয় এক জয়েও দর্শকদের মধ্যে কোনো উল্লাস নেই। ততক্ষণে যে তারা জেনে গেছেন, যা ঘটছে, তাতে ফুটবল স্রেফ গৌণ একটি ব্যাপার। প্যারিস জুড়ে এখানে-ওখানে পড়ে আছে মৃতদেহ।
ম্যাচ শেষ হওয়ার পরেই সাউন্ড সিস্টেমে জানানো হয় দুর্ঘটনার খবর। দর্শকদের পশ্চিমের গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে বলা হয়। কিন্তু আতঙ্কিত দর্শকেরা কেউ স্টেডিয়ামের বাইরে বেরোতে রাজি হন না। গেট ‘জে’-তে বোমা হামলা দুটি হয়েছে বলে তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়। যাতে কমপক্ষে তিনজন নিহত ও একাধিক আহত হয়েছেন।
ততক্ষণে বোঝা গেছে, স্টেডিয়ামের ভেতরেই তারা নিরাপদ। সবাই নেমে আসেন মাঠে। যে সবুজ মাঠ ফুটবলের উত্তেজনা, রোমাঞ্চ উপহার দিতে তৈরি, সেই মাঠ ৭০ হাজার সন্ত্রস্ত মানুষকে ঠাঁই দেয়। খেলোয়াড়ের টানেলে গিয়ে টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারিত খবরে হালনাগাদ খবর নিতে থাকেন। এ সময় খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তা সবাই হতবিহ্বল।
এরই মধ্যে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পরবর্তী প্রীতি ম্যাচসহ যাবতীয় ফুটবলীয় কর্মসূচি স্থগিত করেছে ফ্রান্স। জীবন যেখানে এমন অনিশ্চিত, সেখানে ফুটবল অর্থহীন!- সংবাদমাধ্যম