এক-দুই ও পাঁচ টাকার ধাতব মুদ্রা (কয়েন) নিয়ে বিপাকে পড়েছেন দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা। রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব কয়েন অচল না হলেও সরকারি-বেসরকারি কোনো ব্যাংকই তা নিচ্ছে না। অলিখিতভাবে ব্যাংকগুলোতে নিষিদ্ধ হয়ে পড়ায় কোটি কোটি টাকার মুদ্রা অলস পড়ে থাকছে ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের কাছে। এতে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। এদিকে হাটে-বাজারে দোকানিরাও কেনাবেচায় কয়েন নিতে অনীহা দেখানোয় বিপাকে রয়েছেন সাধারণ মানুষ।
ব্যাংক শাখা ধাতব মুদ্রা, কম মূল্যমান ও ছেঁড়া-কাটা নোট না নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আগেও বিভিন্ন অভিযোগ এসেছে। ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করা হলেও বেশিরভাগ শাখা তা মানছে না। সর্বশেষ গত ৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে দেওয়া এক নির্দেশনায় বলা হয়, ধাতব মুদ্রা, নিম্ন মূল্যমানের নোট ও ছেঁড়া-ফাটা নোট বিনিময়ের ক্ষেত্রে জনসাধারণ বিড়ম্বনার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ আসছে। এ ধরনের কার্যক্রম তাদের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক লেনদেনে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। এমন প্রেক্ষাপটে এসব মুদ্রা না নিলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, যে কোনো মূল্যমানের ধাতব মুদ্রা বা নোট না নেওয়ার সুযোগ ব্যাংকের নেই। জনসাধারণও এ ধরনের মুদ্রা নিতে বাধ্য। তবে এক, দুই ও পাঁচ টাকা মূল্যমানের ধাতব মুদ্রা ও কিছু ক্ষেত্রে এসব মানের নোট কিছু ব্যাংক না নেওয়ার অভিযোগ তারাও পাচ্ছেন। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ডেকে বা টেলিফোনে সতর্ক করা হচ্ছে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে এ বিষয়ে অবহিত করা হচ্ছে। এরপরও কোনো ব্যাংক না নিলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ নিয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন নবাবগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি মো. ইব্রাহীম খলিল, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ)
প্রতিনিধি মো. হুমায়ুন কবির, সাটুরিয়া (মানিকগঞ্জ) প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম এবং বাঘা (রাজশাহী) প্রতিনিধি আবদুল লতিফ মিঞা।
দোহার-নবাবগঞ্জ :ঢাকার দোহার-নবাবগঞ্জ উপজেলাতে ১, ২ ও ৫ টাকার ধাতব কয়েন নিচ্ছেন না দোকানিরা। এ উপজেলায় ব্যাংকের স্থানীয় শাখাগুলোতেও কয়েন লেনদেনে দেখা গেছে অনীহা। ফলে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে আনন্দবশত মাটির ব্যাংকে পয়সা জমানো শিশুরাও। গত মঙ্গলবার দুপুরে নবাবগঞ্জ উপজেলা সদর, বাগমারা বাজার, সাদাপুর বাজার, বান্দুরা বাজারসহ দুই উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা যায়, কোনো দোকানিই একাধিক টাকার কয়েন নিচ্ছেন না। কয়েন না নেওয়ার বিষয়ে এসব দোকানির কাছে জানতে চাইলে, উল্টো তাদের অভিযোগ, কোনো ব্যাংক কিংবা খাদ্যপণ্য কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরাও কয়েন নেন না। এতে লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের।
নবাবগঞ্জ উপজেলার ব্যবসায়ী মো. বাচ্চু মোল্লা ও দোহার উপজেলার জয়পাড়া বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মো. কাশেম জানান, ছোট বা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ১০০ বা ২০০ টাকার সমপরিমাণ কয়েন না নিলে কেউ মালাপত্র নিতে চান না। কিন্তু সেগুলো ব্যাংক বা কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা নেন না। হাজার হাজার টাকার কয়েন জমা পড়ে আছে।
অন্যদিকে কয়েন চলছে না গুজবে মাটির ব্যাংকে (ঘট) জমানো মুদ্রা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন শিশু-কিশোর, ছাত্র/ছাত্রী ও গৃহবধূরা। নবাবগঞ্জ উপজেলার স্কুলছাত্রী সামিমা কাজী জানায়, তার মাটির ব্যাংকে প্রায় ২ হাজার টাকার কয়েন জমেছে। সেগুলো এখন কেউ নিতে চায় না। ভিক্ষুকরাও এগুলো নেয় না।
এ ব্যাপারে সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের নবাবগঞ্জ শাখা ম্যানেজার মো. আলমগীর হোসেন মিয়া জানান, গ্রাহকরা আমাদের কাছ থেকে কয়েন না নেওয়ায় আমরাও গ্রাহকদের কাছ থেকে নিচ্ছি না।
সাটুরিয়া :সাটুরিয়া উপজেলার কয়েকটি বড় বাজার ঘুরে দেখা যায়, এখানকার ব্যবসায়ীদের কাছে কোটি টাকার ছোট নোট ও অর্ধকোটির টাকার কয়েন অলস পড়ে আছে। বালিয়াটী বাজারের ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ রায় জানান, গ্রামাঞ্চলের ছোট ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারিভাবে পণ্য বিক্রি করলে তারা দুই-পাঁচ টাকার কয়েনই বেশি দেন। প্রতি মাসেই তার লাখ টাকার কয়েন আসে। অথচ ব্যাংক সেগুলো নেয় না।
বালিয়াটী গ্রামের সবুজ মিয়ার স্ত্রী সালেহা বেগম তার মাটির ব্যাংকে জমানো ৫শ’ টাকার কয়েন নিয়ে সাটুরিয়া কৃষি ব্যাংকে যান বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে। কৃষি ব্যাংক ওই কয়েন না নিয়ে তাকে নোট নিয়ে আসতে বলেন। সালেহা জানান, ব্যাংকের আচরণ দেখে মনে হয় সরকার ধাতব মুদ্রা কয়েন ও ছোট মানের টাকা অচল করে দিয়েছে।
সাটুরিয়া সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার জামান আল মামুন বলেন, কয়েন নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আর দুই টাকা ও পাঁচ টাকা এবং দশ টাকার নোটে বেশি ছেঁড়াফাটা থাকায় এসব নোট নেওয়া হয় না।
বাঘা :উপজেলার দিঘা বাজারের মুদি ব্যবসায়ী আকরাম হোসেন প্রতিদিন দোকানে বিক্রি শেষে মাটির ব্যাংকে ৫ টাকার মুদ্রা ফেলে জমা করেছেন ১৮ হাজার ৪৬০ টাকা। ব্যাংকটি ভাঙার পর এই টাকা নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন তিনি। একটি পলিথিনে রাখা বিপুল সংখ্যক মুদ্রা দেখিয়ে আকিজ কোম্পানির এক প্রতিনিধির সাক্ষাতে তুষার স্টোরের স্বত্বাধিকারী সিদ্দিকুর রহমান জানালেন একই সমস্যার কথা। সোনালী ব্যাংক বাঘা শাখার ব্যবস্থাপক বদরুজ্জোহা জানান, কয়েন রাখার জায়গা সংকটসহ গুনে নেওয়ার ঝামেলায় তারা কয়েন নিতে রাজি হন না। তবে একেবারেই নেওয়া হয় না এ রকমটা নয়।
গৌরীপুর :গৌরীপুরের বিভিন্ন ব্যাংকে কয়েন নেওয়া অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ হয়ে আছে। এতে এক বছর ধরে ব্যবসায়ীদের কাছে লাখ লাখ টাকার কয়েন জমা হয়ে আছে। কেউ কেউ আবার শতকরা ৫ থেকে ১০ টাকা কমে কয়েন বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। গৌরীপুর পৌর শহরের সুমি বেকারির প্রোপাইটার মো. সাদেক বলেন, ‘বেকারির খাবার বিক্রি করতে গিয়ে প্রতিদিন দোকানিদের কাছ থেকে কয়েন নিতে হচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকে কয়েন জমা দিতে গেলে তারা তা নিচ্ছেন না। এ অবস্থায় দুই মাস আগে ২০ হাজার টাকার কয়েন বিক্রি করেছি মাত্র ১৮ হাজার টাকায়।’
উপজেলার জনতা, সোনালী ও কৃষি ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকে কয়েন নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। কয়েন গুনতে সময় লেগে যায়। এ কারণে অন্য গ্রাহকদের সেবা দিতে সমস্যা হয়। এ কারণে বেশি পরিমাণে কয়েন নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সোনালী ব্যাংক গৌরীপুর শাখার ব্যবস্থাপক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘কয়েন জমা দিতে এসে কেউ ফেরত গেছে, এমন কোনো অভিযোগ আমার কাছে আসেনি।’
জনতা ব্যাংক গৌরীপুর এসি শাখার ব্যবস্থাপক মো. মোশারফ হোসেন বলেন, ‘আমরা কমবেশি কয়েন নিচ্ছি। একেবারেই যে কয়েন নিচ্ছি না এই অভিযোগটি সত্যি নয়।