চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় দায়ের হওয়া দু’টি মামলায় জামায়াতের আমীর ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়াসহ সম্পূরক চাজর্শিটভুক্ত ১১ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেছেন চট্টগ্রামের একটি আদালত।
একইসঙ্গে আদালত আগামী ২৯ নভেম্বর এ মামলার প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণের দিন নির্ধারণ করেছেন।
এর মধ্য দিয়ে বহুল আলোচিত এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হল।
মঙ্গলবার আসামীদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের উপর অসমাপ্ত শুনানি শেষে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মুজিবুর রহমান অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্য গ্রহণের দিন নির্ধারণ করেন।
আসামীদের মধ্যে ৯ জন গ্রেপ্তার আছেন। এরা হলেন, জামায়াত নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই’র ওই সময়ের মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই’র তৎকালীন পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআই’র সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার সাহাবুদ্দিন, উপ-পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন, ফিল্ড অফিসার আকবর হোসেন খান, রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা সিইউএফএল’র সাবেক এমডি মোহসীন তালুকদার এবং সাবেক মহাব্যবস্থাপক এনামুল হক।
এছাড়া বাকি দু’জন আসামি পলাতক আছেন। এরা হলেন, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রণ্ট অব আসাম (উলফা) ’র সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়–য়া ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব নূরুল আমিন।
এ মামলার রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলী ও মহানগর পিপি অ্যাডভোকেট কামালউদ্দিন আহম্মদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘দুটি মামলাতেই পলাতক দু’জনসহ ১১ জন আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নিয়ে আদালত তাদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেছেন। ২৯ নভেম্বর থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ চলবে।’
দুটি মামলার মধ্যে একটি অস্ত্র আটকের ঘটনায় অস্ত্র আইনের মামলা এবং অপরটি চোরাচালান আইনে দায়ের হওয়া মামলা।
প্রথম মামলায় অবৈধভাবে অস্ত্র আনা এবং দখলে রাখার অপরাধে ১৯৭৮ সালের অস্ত্র আইনের ১৯ (এ) ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এ মামলায় প্রথম দফায় চার্জ গঠন করা হয়েছিল ৩৯ জনের বিরুদ্ধে। নতুন ১১ জনসহ মোট আসামি ৫০ জন।
অপর মামলায় চোরাচালানের মাধ্যমে বিদেশ থেকে অবৈধ মালামাল আনায় সহায়তা করার অপরাধে ২৫ (বি) (১)/ ২৫ (ডি) ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এ মামলায় প্রথমে চার্জ গঠন করা হয়েছিল ৪১ জনের বিরুদ্ধে। নতুন ১১ জনসহ মোট আসামি ৫২ জন।
অভিযোগ গঠনের সময় সম্পূরক চার্জশিটভুক্ত গ্রেপ্তার থাকা ৯ আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া মূল চার্জশিটভুক্ত দু’আসামি ট্রলার মালিক দীন মোহাম্মদ এবং চোরাচালানী হিসেবে অভিযুক্ত হাফিজুর রহমানও এসময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তারাও বর্তমানে কারাবন্দী আছেন।
এর আগে গতকাল সোমবার সম্পূরক চার্জশিটভুক্ত ১১ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়। প্রথম দফায় গতকাল ৬ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের ওপর আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য গ্রহণ করেন আদালত। সাত নম্বর আসামি অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিমের আইনজীবীর বক্তব্য আংশিক গ্রহণের পর আদালতের কার্যক্রম মঙ্গলবার পর্যন্ত মূলতবি করা হয়।
মঙ্গলবার বেলা ১২টায় শুরু হয় বাকি আব্দুর রহিম, রেজ্জাকুল হায়দার ও আকবর হোসেন খানের আইনজীবীর বক্তব্য গ্রহণ। এসময় আইনজীবীরা এ মামলায় তাদেরকে রাজনৈতিক উদ্দেশে হয়রানির জন্য আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। তারা এজন্য মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা, সিআইডির সিনিয়র এএসপি মো.মনিরুজ্জামানকে দায়ী করে বক্তব্য রাখেন।
দুপুর দেড়টায় তিনজনের আইনজীবীর বক্তব্য গ্রহণ শেষে শুরু হয় রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য। এতে অংশ নিয়ে মহানগর পিপি অ্যাডভাকেট কামালউদ্দিন বলেন, ‘যে ঘটনায় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল সেখানে হাস্যকর তদন্তের মাধ্যমে কয়েকজন শ্রমিক, চালক, ক্যারিয়ারকে আসামি করা হয়েছিল। আগের তদন্তকারী কর্মকর্তারা মূল আসামিদের রক্ষার চেষ্টা করেছেন। মাত্র দু’মাস তদন্ত করে এতবড় একটি ঘটনার চার্জশিট দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘এ মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের মধ্যে নিজামী সাহেব ও বাবর সাহেব ছাড়া বাকি আসামিরা সবাই বিভিন্ন পর্যায়ের ওই সময়ের সরকারি কর্মকর্তা। সুতরাং এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশে আসামি করার অভিযোগ সত্য নয়। আইনজীবীরা তাদের মক্কেলদের সন্তুষ্ট করার জন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কথা বলছেন। কিন্তু আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগ প্রমাণ করব।’
মাঝখানে একঘণ্টার বিরতি ছাড়া একটানা উভয়পক্ষের আসামিদের বক্তব্য গ্রহণ শেষে বিকেল পৌনে ৪টায় আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা সিইউএফএল’র জেটিতে খালাসের সময় ধরা পড়ে দশ ট্রাক অস্ত্রের চালান।
এ ঘটনায় পরদিন কর্ণফুলী থানার তৎকালীন ওসি আহাদুর রহমান বাদী হয়ে অস্ত্র আটক ও চোরাচালান আইনে দুটি মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাও হন ওসি আহাদুর রহমান। এ নিয়োগ নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হলে ২৬ এপ্রিল তদন্তভার দেওয়া হয় সিআইডির এএসপি একেএম কবির উদ্দিনকে।
২০০৪ সালের ১১ জুন এএসপি কবির উদ্দিন দুটি মামলার মধ্যে অস্ত্র মামলায় ৪৩ জনকে এবং চোরাচালান মামলায় ৪৫ জনকে আসামি করে চাজর্শিট দাখিল করেন। ওই চার্জশিট অনুযায়ী বিচার চলাকালে দুটি মামলার ৪ জন আসামি মারা যান। পরে তাদের আসামির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
এর মধ্যে বিগত তত্তাবধায়ক সরকারের আমলে ওই সময়ের পিপি আহসানুল হক হেনার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের মহানগর দায়রা জজ মামলা দুটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন।
অধিকতর তদন্তের শুরুতে প্রথমে মামলা তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির এএসপি ইসমাইল হোসেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সরিয়ে মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির সিনিয়র এএসপি মো.মনিরুজ্জামানকে।
এরপর থেকেই মূলত খুলতে থাকে এ মামলার রহস্যের জট। ২০০৯ সালে দশ ট্রাক অস্ত্র খালাসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকজন সাবেক শীর্ষ সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি তদন্তে ভিন্ন মোড় নেয়। এরপর থেকে তাদের জবানবন্দীসহ বিভিন্নভাবে বেরিয়ে আসতে থাকে একের পর এক নেপথ্যের রহস্য।
অধিকতর তদন্ত শুরুর আগেই গ্রেপ্তার ছিলেন এ মামলার অন্যতম আসামি চোরাচালানি হাফিজুর রহমান। ২০১০ সালের ৬ ফেব্রয়ারি আদালতে ১৬৪ ধারায় ৪৩ পৃষ্ঠার দীর্ঘ জবানবন্দি দিয়ে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে হাফিজ এ মামলা তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেন।
এরপর দশ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির পাঁচ সদস্যের মধ্যে চার সদস্য আদালতে জবানবন্দী দেন। এদের মধ্যে ২০১০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ডিআইজি (সিআইডি) ফররুখ আহমেদ, ২৬ সেপ্টেম্বর ডিআইজি (এসবি) শামসুল ইসলাম, ১৮ সেপ্টেম্বর এনএসআই’র সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এনামুর রহমান এবং ৩০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের ওই সময়ের পুলিশ কমিশনার এম সাব্বির আলী আদালতে জবানবন্দী দেন।
এদের মধ্যে এনামুর রহমান চৌধুরী তার জবানবন্দীতে সঠিক তদন্ত না হওয়ার জন্য এবং এনএসআইকে আড়াল করার জন্য সরাসরি বাবরকে দায়ী করেন।
এছাড়া ২০১০ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি)’র সাবেক চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান চৌধুরী বীরবিক্রম এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের ওই সময়ের সচিব ড.শোয়েব আহমেদ জবানবন্দী দিয়ে মামলার তদন্তের মোড় আরেক দফা ঘুরিয়ে দেন।
জবানবন্দীতে ইমামুজ্জামান তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীকে উদ্ধৃত করে দশ ট্রাক অস্ত্র খালাসের বিষয়টি ‘জোট সরকারের হাইয়েস্ট অথরিটির’ অবগত থাকার কথা বলেন। অন্যদিকে শোয়েব আহমেদ বলেন, দশ ট্রাক অস্ত্র আটকের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন নিজামী।
উল্লেখ্য, সাড়ে তিন বছর ধরে চলা অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডি আদালত থেকে ১৪ দফা সময় নেন। এরপর গত ২৬ জুন আদালতে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করে মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি।