দুনিয়াজুড়ে এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা চলছে। কোথাও ঝড়, কোথাও বন্যা, কোথাও খরা, কোথাও দাবানল, কোথাও শৈত্যপ্রবাহ—এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় লেগেই আছে। প্রকৃতির দোষ দিয়ে অবশ্য লাভ নেই। কারণ মানুষেরই অপকর্মের জের টানছে প্রকৃতি। মানুষ প্রকৃতিবিরোধী কাজ করে। প্রকৃতিও ফুঁসতে থাকে সম্পদ ও ভারসাম্য হারানোর ক্ষোভে। ফুঁসতে ফুঁসতে একসময় রুদ্ররোষে থাবা মেরে বসে। লন্ডভন্ড করে দেয় জনপদ।সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’-এর প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়। ছবি: প্রথম আলো
সবুজ পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকর গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন রোধে সভা-সম্মেলন যতই হোক না কেন, বাস্তবে এর কোনো কার্যকারিতা নেই। বড় বড় উন্নত দেশ যারা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির বিপক্ষে কথা বলছে, তারাই ধুমসে ব্যবহার করছে এ জ্বালানি। এতে ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন বেড়েই চলেছে। ক্ষয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর রক্ষাকবচ ওজোন স্তর। বাড়ছে খরা, অতিবৃষ্টি, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও শৈত্যপ্রবাহের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। যার মাশুল গুনতে গিয়ে বিপন্ন জীববৈচিত্র্য। হুমকির মুখে বাস্তুসংস্থান। পরিস্থিতি এতটাই ঘোরালো যে পরিবেশবাদীরাও যেন ইদানীং হাল ছেড়ে দিয়েছেন। দূষণ রোধে আগের মতো তাঁদের রা-টা নেই। আমরা যেন পৃথিবীর ক্ষয় দেখার নীরব দর্শক। কারও যেন কিচ্ছু করার নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের কথা যদি বলি, তাহলে সে দেশে পদে পদে রয়েছে দুর্যোগের কোপ। বিশাল অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ায় একটানা খরা চলছে তো চলছেই। গনগনে রোদে পুড়ে তামা হয়ে গেছে মাটি। দিগন্তজোড়া মাঠে ফসলের দেখা নেই। পানি নিয়ে কৃচ্ছ্র সাধন করেও এ খরার ধকল কাটানো যাচ্ছে না। বরং খরার কারণে কয়েক দফায় দেখা দেওয়া দাবানলে পুড়ে বিরান হয়েছে বেশ কিছু মানব বসতি।
অক্টোবরে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় হুদহুদ। ভারতের উপকূলীয় এলাকা থেকে ছবিটি তোলা। ছবি: এএফপিএদিকে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে টেক্সাস আর ওকলাহোমায়। এতে খরার মন্দা কাটলেও আকস্মিক বন্যায় বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে হিউস্টন ও টেক্সাস হিল কাউন্টিতে। দেশটির পূর্বাঞ্চলে শীতের জাঁতাকলে পড়ে ক্ষতির পরিমাণ ২৯০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ বারবার যে হানা দিয়েছে, তা রীতিমতো দানবীয় তাণ্ডব। এ মাসের (অক্টোবর) প্রথম দিকে ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ঝড় আর বন্যায় ১৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। ইউরোপের মধ্যাঞ্চলের কয়েকটি দেশে এখন ভয়াবহ বন্যা। অতিবৃষ্টিতে দানিউব নদের পানি ফুঁসে ওঠে তীরবর্তী দেশগুলোর বিস্তীর্ণ এলাকা ভাসিয়ে দিয়েছে। এনবিসি নিউজ ডটকমসহ বিভিন্ন বার্তা সংস্থার খবরে জানানো হয়, গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এই বন্যা। ইউরোপে বন্যার কারণে প্রাণহানি ইতিমধ্যে এক শ জন ছাড়িয়ে গেছে। হাঙ্গেরিতে দানিউব নদের পানির উচ্চতা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। অস্ট্রিয়া ও চেক প্রজাতন্ত্রেও বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে হাজারো মানুষ।
এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় এ বছর বেশ কয়েকবার সামুদ্রিক ঝড় ও আকস্মিক বন্যা সীমাহীন দুর্ভোগ বয়ে আনে। এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ফিলিপাইনে ‘কোপ্পু’ নামের টাইফুনটি আঘাত হানে। এতে খুব বেশি প্রাণহানি না ঘটলেও ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়। এর জের এখনো টানছে দেশটি।
চীন ও তাইওয়ানে গত আগস্টে টাইফুন ‘সুডেলর’ আঘাত হানে। চীনের উপকূল থেকে ছবিটি তোলা। ছবি: এএফপিএর আগে গত আগস্টে চীন ও তাইওয়ানে টাইফুন ‘সুডেলর’ আঘাত হানে। এতে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ৩৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। একই মাসে টাইফুন ‘গোনি’ জাপানে আঘাত হানে। এমনই আরও কিছু ঝড়ঝঞ্ঝা ওই এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে।
গত শুক্রবার মেক্সিকোর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে সামুদ্রিক ঝড় প্যাট্রিসিয়া। সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, এর আগে এমন হারিকেন কখনো আঘাত করেনি সে দেশে। শক্তির ধরন অনুযায়ী ক্ষয়ক্ষতি সেরকম না হলেও তা একেবারে কম ছিল না।
ইন্দোনেশিয়ায় কৃষিজমি তৈরির জন্য বিশাল এলাকাজুড়ে বনজঙ্গল সাফ করে গাছ পোড়ানো হচ্ছে। এতে বিপুল পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ছড়াচ্ছে। মাস দুয়েক ধরে মানব-সৃষ্ট এই দুর্যোগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে এখন ধোঁয়াশা বিরাজ করছে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়ার অনেক এলাকায় লোকজন ঠিকমতো শ্বাস টানতে পারছে না। দেখা দিয়েছে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন সমস্যা। মালয়েশিয়ায় এর মধ্যে কয়েক দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্ব পরিবেশ পর্যবেক্ষকেরা এর মধ্যে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
গ্রিন হাউস গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত নির্গমনে ওজোন স্তর ক্ষয়ে গিয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। গলে যাচ্ছে মেরু অঞ্চল ও সুউচ্চ পর্বতমালায় জমে থাকা হিমবাহ ও বরফের স্তর।
পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞদের তথ্যের বরাত দিয়ে সম্প্রতি এএফপির প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত এক শতাব্দীতে পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের তাপমাত্রা ১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। শুধু পাকিস্তান নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতেও ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যাপক প্রাণহানি ঘটাচ্ছে। ঘটছে ভূমিধস ও ভূমিকম্পের মতো প্রলয়ংকরী ঘটনা। গত এপ্রিলে নেপালে বড় ধরনের ভূমিকম্পে নয় হাজারের বেশি লোক প্রাণ হারায়।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলে ‘সিডর’ ও ‘আইলার’ ক্ষত এখনো মুছে যায়নি। নদীদূষণ কোন পর্যায়ে রয়েছে, এক বুড়িগঙ্গার দুর্গন্ধময় কালো জলই তা বলে দেয়। বায়ু ও পরিবেশদূষণ নিয়ে অনেক দিন ধরেই হইচই, লেখাজোখা চলছে। কিন্তু নদী আর খালে কারখানার রাসায়নিক পদার্থের বর্জ্যের স্রোতোধারার গতিপথ বদলায়নি।
আগামী ডিসেম্বরে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলন। এই সম্মেলনে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়াও যোগ দেবে। কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারণে এ দেশটি বরাবরই পরিবেশবাদীদের কঠোর সমালোচনার মুখে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী এ কারণে এ ধরনের সম্মেলন এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতেন। অস্ট্রেলিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুলকে নিয়ে অনেকে আশাবাদী। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন বলে তিনি কথা দিয়েছেন। তাঁর মতো উন্নত দেশগুলোর নেতারা কথাকে কাজে পরিণত করলে এই ধরণির উত্তপ্ত হওয়ার পথ কিছুটা হলেও ধীর হবে।