তল্লাশিচৌকিতে পুলিশ কর্মকর্তা খুনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ চক্রের সঙ্গে যুক্ত বলে দাবি করেছে পুলিশ। এর মধ্যেই রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে ‘শিবিরের আস্তানা’ থেকে পাঁচটি হাতে তৈরি গ্রেনেড উদ্ধার এবং ঢাকা ও বগুড়া থেকে অন্তত ২৮ জনকে গ্রেপ্তার ও আটক করা হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রগুলো জানিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর গাবতলীতে তল্লাশিচৌকিতে এক সন্দেহভাজনের ব্যাগ তল্লাশির সময় দারুস সালাম থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ইব্রাহিম মোল্লাকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ মাসুদুর রহমান নামে এক তরুণকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই গতকাল ২৮ জনকে আটক করা হয়। সর্বশেষ গত রাত পৌনে ১২টায় যোগাযোগ করা হলে দারুস সালাম থানার কর্তব্যরত উপপরিদর্শক (এসআই) আবু বকর সিদ্দিক বলেন, এ ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি।
পুলিশ সূত্রগুলো জানায়, দূরপাল্লার একটি বাস থেকে নামার পরে তিন তরুণকে পুলিশ তল্লাশির জন্য থামতে বলে। এ সময় এএসআই ইব্রাহিম একজনের ব্যাগ তল্লাশি করছিলেন। একপর্যায়ে আরেকজন তাঁকে ছুরিকাঘাত করেন। হামলাকারীসহ দুজন পালিয়ে গেলেও তাঁদের একজন মাসুদুর রহমানকে আটক করে পুলিশ। মাসুদকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পারে, এএসআই ইব্রাহিমকে ছুরিকাঘাত করেছিলেন কামাল।
গতকাল শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে ইব্রাহিমের মরদেহ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে নেওয়া হয়। সেখানে জানাজায় অংশ নেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি)সহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সহকর্মী ও স্বজনেরা। জানাজার পরে আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, যে মূল অপরাধী (কামাল), যিনি হত্যা করেছেন তিনি পলাতক। তাঁর সহযোগী অপরাধীকে (মাসুদুর) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কামরাঙ্গীরচরে অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও অন্য জায়গায় অভিযান চলছে। এতে মনে হচ্ছে, তারা সংঘবদ্ধ একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ, যারা এ দেশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে না, এ দেশের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নকে পছন্দ করে না। মাসুদ এ ধরনের একটি সংগঠনের সদস্য বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তারপরও তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেওয়া যাবে না।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, মাসুদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কামরাঙ্গীরচরে তাঁদের আস্তানা থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও বোমা এবং গাজীপুর থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে বলা যাবে এ ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত।
দারুস সালাম থানার পুলিশ জানায়, মাসুদ বগুড়ায় ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দুই সহযোগীসহ মাসুদ ঢাকায় বড় নাশকতার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তিকে হত্যারও পরিকল্পনা ছিল তাঁদের।
ছুরিকাঘাতে নিহত দারুস সালাম থানার এএসআই ইব্রািহম মোল্লার জানাজা গতকাল জুমার নামাজের পর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় অন্যদের মধ্যে তাঁর শোকার্ত স্বজন ও সহকর্মীরা অংশ নেন l ছবি: প্রথম আলোকামরাঙ্গীরচর থানার পুলিশ জানিয়েছে, গতকাল ভোর সাড়ে চারটা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত কামরাঙ্গীরচরে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। যে বাসায় অভিযান চালানো হয়েছে, তা রফিক নামের একজনের সঙ্গে ভাড়া নিয়েছিলেন মাসুদ। সেখানে কামালও থাকতেন। এই কামালই এএসআই ইব্রাহিমকে ছুরি মেরেছেন বলে জানানো হচ্ছে।
ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) সূত্র জানায়, বগুড়া শহরে মাসুদ যে মেসে থাকতেন, সেখান থেকে আটক করা হয়েছে শিবিরের ২১ জন কর্মীকে। মাসুদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পরে বগুড়ার আদমদীঘি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আরও চারজনকে।
প্রথম আলোর বগুড়া অফিস জানায়, আদমদীঘি থেকে গ্রেপ্তার চারজনের পরিচয় জানিয়েছে পুলিশ। এঁরা হলেন আদমদীঘি সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি রফি আহমেদ, উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও একটি দৈনিক পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি মেহেদি হাসান, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা জামায়াতের নায়েবে আমির ইউনুস আলী এবং সাবেক ইউপি সদস্য তৌফিকুল ইসলাম। আর বগুড়া রেলগেট-সংলগ্ন পুরান বগুড়া এলাকার মসজিদ ছাত্রাবাস থেকে ২১ জন তরুণকে আটক করা হয়। এই ছাত্রাবাসেই থাকতেন গ্রেপ্তার হওয়া মাসুদ।
বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার পালপাড়া গ্রামের বাড়িতে নিহত ছেলের ছবি কোলে নিয়ে মা। পাশে বাবা আর চার বোন। পুরো পরিবার এখন পাগলপ্রায়। গতকাল তোলা ছবি l প্রথম আলোগ্রেপ্তার ২১ জনের বেশির ভাগই সরকারি আজিজুল হক কলেজের ছাত্র। এঁরা হলেন কোরবান আলী, বিপুল মিয়া, সোহেল রানা, শফিকুল ইসলাম, ফরহাদ হোসেন, দেলোয়ার হোসেন, রায়হান আলী, কাউসার আলী, মেহেদি হাসান, মাসুদ রানা, সাজেদুর রহমান, সাদ্দাম হোসেন, রুহুল আমিন, রুম্মন মিয়া, মহসিন আলী, জুয়েল রানা, সিজু মিয়া, সুলতান মাহমুদ, নাজমুল হক, কামরুজ্জামান ও গোলাম মোস্তফা। বগুড়ার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এই ২১ জন শিবিরের কর্মী বলে তাঁদের কাছে তথ্য রয়েছে।
এদিকে গতকাল গাবতলীর ঘটনাস্থলে গিয়ে ঠিক কোন জায়গায় ইব্রাহিমকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, তা শনাক্ত করা যায়নি। সাধারণত আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে আলামত সংগ্রহের জন্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল হলুদ ফিতা দিয়ে ঘিরে, ইট বিছিয়ে বা অন্য কোনোভাবে সংরক্ষণ করে পুলিশ। কিন্তু এএসআই ইব্রাহিম হত্যাকাণ্ডের স্থলটি সংরক্ষণ করা হয়নি। সেখানে দারুস সালাম থানার এসআই নওশের এবং এএসআই রহিজুল দায়িত্ব পালন করলেও তাঁরা ঘটনাস্থলটি দেখাতে পারলেন না। তবে পর্বত প্রেক্ষাগৃহের উল্টো দিকের চায়ের দোকানদার নিবাস ঘোষ জানালেন, তিনি ঘটনাটি দেখেননি, তবে শুনেছেন যে রাস্তার পাশে ছুরিকাহত হয়ে পর্বত প্রেক্ষাগৃহের প্রাঙ্গণে এসে পড়ে যান এএসআই ইব্রাহিম। নিবাস ঘোষ হাত দিয়ে একটা জায়গা দেখিয়ে দিলেন। পর্বত প্রেক্ষাগৃহের ওই প্রাঙ্গণ ডিপজল পরিবহনের বাস রাখার নির্ধারিত জায়গা।
এএসআই ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির প্রধান হলেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) শেখ মুহম্মদ মারুফ হাসান এবং অপর দুই সদস্য মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার কাইয়ুমুজ্জামান ও ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) উপকমিশনার সাজ্জাদুর রহমান।
এদিকে গতকাল রাতে পাঠানো এক বিবৃতিতে ইব্রাহিম মোল্লা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জামায়াত-শিবির জড়িত বলে পুলিশের মহাপরিদর্শক যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার প্রতিবাদ জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ বিবৃতিতে বলেন, যথাযথ তদন্ত ছাড়াই আইজিপি জামায়াতকে দায়ী করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।