কোম্পানির ক্ষতি ও লাভের পরিমাণ কম দেখাতে গিয়ে ১০ কোটি টাকা ভুয়া খরচ দেখিয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওষুধ ও রসায়ন খাতের প্রতিষ্ঠান বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন খাতে খরচের বিপরীতে কোনো ধরনের বিল বা ভাউচার নেই। মূলত বিভিন্ন খাতে দেখানো খরচ পুরোটাই কোম্পানি কর্তৃপক্ষ আত্মসাৎ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এক কোটি ৭১ লাখ ৮২ হাজার ৩২০ টাকা ক্ষতি দেখিয়েছে এবং ২০০৯-১০ অর্থবছরের প্রতিষ্ঠানটি লাভ দেখিয়েছে দুই কোটি ৪১ লাখ ১৪ হাজার ৮৫০ টাকা।
জানা গেছে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি দাবি করা খরচের মধ্যে তিন কোটি ৭৩ লাখ ৭০ হাজার ১৬৪ টাকার বিপরীতে কোনো বিল কিংবা ভাউচার দেয়নি এনবিআরকে। আর ২০০৯-১০ অর্থবছরে ছয় কোটি ৩৭ লাখ ৬৫ হাজার ১৭৫ টাকা খরচের বিপরীতে কোনো প্রকার বিল-ভাউচার দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি।
এই দুই বছরে প্রতিষ্ঠানটি মোট ১০ কোটি ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৩৯ টাকা খরচের বিল-ভাউচার উপস্থাপন করেনি।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি কোম্পানির জন্য দৈনন্দিন খরচের হিসাব ও খরচের স্বপক্ষে যথাযথ বিলÑভাউচার সংরক্ষণ করা বাধ্যতামূলক। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান হিসাব সংরক্ষণ না করে কিংবা হিসাবের স্বপক্ষে কোনো ধরনের বিল-ভাউচার সংরক্ষণ না করে, তা আন্তর্জাতিক ও দেশীয় একাউন্টিং মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য নয়।’
এছাড়া যদি কোনো কোম্পানির কোনো প্রকার খরচের বিপরীতে তথ্য-উপাত্ত বা বিল-ভাউচার উপস্থাপন না করে, তবে ওই খরচটি হয়নি বলে বিবেচিত হওয়ার কথা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, কোনো কোম্পানি যথাযথ কাগজপত্রের বাইরে কোনো খরচ দেখাতে পারে না। এ বিষয়ে অডিট আপত্তি দেওয়ার কথা। তবে এর মাধ্যমে এও ধরে নেওয়া যেতে পারে, প্রতিষ্ঠানটি ব্যয় না করে ওই অর্থ খরচ দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছে।
এনবিআর সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, বিকন ফার্মা উক্ত দুই বছরে প্রশাসনিক খাতে যে ব্যয় দেখিয়েছে তার মধ্যে এক কোটি ৪৩ লাখ ৬৭ হাজার ৪৭২ টাকার কোনো প্রকার বিল-ভাউচার নেই।
এছাড়া বিক্রয় ও বিতরণ খাতের ব্যয়ের মধ্যে পাঁচ কোটি ৮৪ লাখ ৭১ হাজার ৩৬২ টাকার কোনো বিল ভাউচার উপস্থাপন করেনি।
আর কারখানা খাতে মোট খরচের মধ্যে দুই কোটি ৮২ লাখ ৯৬ হাজার ৫০৯ টাকার হিসেবের স্বপক্ষে কোনো প্রকার বিল ভাউচার উপস্থাপন করেনি প্রতিষ্ঠানটি।
২০০৭-০৮ অর্থবছরের নিম্নোক্ত খরচের বিপরীতে কোনো বিল ভাউচার উপস্থাপন করেনি
প্রশাসনিক খাত
১. ভ্রমণ ও যাতায়াত খাতে ১০ লাখ ২৮ হাজার ৪৮৩ টাকা
২. ওয়েলফেয়ার ও রিক্রিয়েশন খাতে দুই লাখ ১৩ হাজার ৩৮ টাকা
৩. দান ও চাঁদা খাতে তিন লাখ ৪১ হাজার ৯০০ টাকা
৪. অফিস ট্রান্সপোর্ট খাতে আট লাখ ৮৪ হাজার ৫৭৫ টাকা
৫. টেলিফোন ও পোস্টার খাতে দুই লাখ ৬ হাজার ২৭৯ টাকা
৬. মুদ্রণ ও মনোহরি খাতে সাত লাখ ২৭ হাজার ৫৮৫ টাকা
৭. গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স খাতে দুই লাখ ২২ হাজার ৪৫০ টাকা
৮. ট্রেনিং খাতে ১৪ লাখ ৭৪ হাজার ৩৮২ টাকা
৯. বিবিধ খাতে তিন লাখ ৪৪ হাজার ১১৮ টাকা
বিক্রয় ও বিতরণ খাত
১. ভ্রমণ ও যাতায়াত খাতে ১৩ লাখ ৩২ হাজার ৫০৬ টাকা
২. টেলিফোন ও পোস্টার খাতে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৮১ টাকা
৩. দান ও চাঁদা খাতে ১৩ হাজার ৮৬৯ টাকা
৪. ট্রান্সপোর্টেশন খাতে ৫ লাখ ৬৭ হাজার ২৩৪ টাকা
৫. মুদ্রণ ও মনোহারি খাতে ২৩ লাখ ৫৪ হাজার ৭১৯ টাকা
৬. মার্কেট রিসার্চ ও নিউ প্রডাকশন খাতে আট লাখ ৩৪ হাজার ৩৫৮ টাকা
৭. ট্রেনিং খাতে ছয় লাখ ৮৫ হাজার ৯৫ টাকা
৮. প্রমোশনাল খাতে এক কোটি ২৮ লাখ ৩১ হাজার ৮৫১ টাকা
৯. ডেলিভারি খাতে ১৪ লাখ ৯৪ হাজার ৬৯০ টাকা
১০. কনফারেন্স খাতে ২১ লাখ ৪০ হাজার ৬৮০ টাকা
১১. ভাড়া খাতে ১৭ লাখ ১১ হাজার ২৯৭ টাকা
১২. বিবিধ খাতে এক লাখ ২৯ হাজার ৯৫৬ টাকা
কারখানা খাত
১. ভ্রমণ ও যাতায়াত খাতে ১৭ লাখ ৬০ হাজার ৫৯৭ টাকা
২. ক্যান্টিন সাবসিডি খাতে ২৯ লাখ ৮২ হাজার ৭৮০ টাকা
৩. ওয়েলফেয়ার ও রিসার্চ খাতে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৭ টাকা
৪. মুদ্রণ ও মনোহারি খাতে ১১ লাখ ৪৭ হাজার ৮০৮ টাকা
৫. রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট খাতে ২৯ লাখ ১৩ হাজার ৭৩৭ টাকা
৬. অন্যান্য খাতে এক লাখ ৪২ হাজার ৮৪২ টাকা
২০০৯-১০ অর্থবছরে নিম্নোক্ত খরচের বিপরীতে কোনো বিল-ভাউচার উপস্থাপন করেনি
প্রশাসনিক খাত
১. ভ্রমণ ও যাতায়াত খাতে ১৫ লাখ ৮৭ হাজার ৪০৫ টাকা
২. ক্যান্টিন খাতে ছয় লাখ ২৮ হাজার ৫৪১ টাকা
৩. ওয়েলফেয়ার ও রিক্রিয়েশন খাতে দুই লাখ ৭২ হাজার ৫১২ টাকা
৪. অফিস ভাড়া খাতে ১২ লাখ ৬০ হাজার টাকা
৫. অফিস ট্রান্সপোর্ট খাতে ১০ লাখ ৪৫ হাজার ২৪০ টাকা
৬. অফিস ইউটিলিটি খাতে দুই লাখ ১৪ হাজার ১৫০ টাকা
৭. টেলিফোন ও পোস্টার খাতে চার লাখ ৭৬ হাজার ৩২৮ টাকা
৮. ফিস অ্যান্ড ট্যাকসেস খাতে ১৪ লাখ ১৭ হাজার ৩৬৭ টাকা
৯. মুদ্রণ ও মনোহারি খাতে সাত লাখ ৩৫ হাজার ২৪২ টাকা
১০. গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স খাতে দুই লাখ ৪৮ হাজার ৬৮০ টাকা
১১. ট্রেনিং খাতে সাত লাখ ৬০ হাজার ৬৫৫ টাকা
১২. বিবিধ খাতে দুই লাখ ৭৮ হাজার ৫৪২ টাকা
বিক্রয় ও বিতরণ খাত
১. ভ্রমণ ও যাতায়াত খাতে ২০ লাখ ৩২ হাজার ১৭০ টাকা
২. সেলস অফিস রেন্ট খাতে ২১ লাখ ৩৬ হাজার ২০৭ টাকা
৩. গোডাউন রেন্ট খাতে দুই লাখ ৭৭ হাজার ৩৪৭ টাকা
৪. ট্রান্সপোর্টেশন খাতে আট লাখ ৭৪ হাজার ৩৯ টাকা
৫. ইউনিলিটিজ খাতে দুই লাখ ৯৬ হাজার ৬৩৮ টাকা
৬. টেলিফোন ও পোস্টার খাতে চার লাখ ৬১ হাজার ১৪৬ টাকা
৭. মুদ্রন ও মনোহারি খাতে ২৩ লাখ ৫৪ হাজার ৭১৯ টাকা
৮. মার্কেট রিসার্চ ও নিউ প্রডাকশন খাতে ১৮ লাখ ১৩ হাজার ২০২ টাকা
৯. ট্রেনিং খাতে নয় লাখ ৮৩ হাজার ৭৪১ টাকা
১০. প্রমোশনাল খাতে এক কোটি ৭২ লাখ ৪৪ হাজার ৪৮৯ টাকা
১১. কনফারেন্স খাতে ৪১ লাখ তিন হাজার ৯০৪ টাকা
১২. ডেলিভারি খাতে ৩২ লাখ ৭৪ হাজার ১২৩ টাকা
কারখানা খাত
১. ভ্রমণ ও যাতায়াত খাতে ৩২ লাখ ১০ হাজার ১০৪ টাকা
২. ক্যান্টিন সাবসিডি খাতে ৪২ লাখ ৪৪ হাজার ৩৭৪ টাকা
৩. ওয়েলফেয়ার ও রিসার্চ খাতে আট লাখ ৪০ হাজার ২৬৩ টাকা
৪. ইউনিফরম খাতে সাত লাখ ২৭ হাজার নয় টাকা
৫. ট্রান্সপোর্টেশন খাতে ১৩ লাখ ১০ হাজার ৫৮১ টাকা
৬. টেলিফোন খাতে আট লাখ ৩২ হাজার ৫৪৫ টাকা
৭. মুদ্রণ ও মনোহারি খাতে ২০ লাখ ৫২ হাজার ৮৬৫ টাকা
৮. রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট খাতে ৪৩ লাখ ২৮ হাজার ২৬৫ টাকা
৯. মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ১৪ লাখ ৪২ হাজার ৭৮২ টাকা
এ বিষয়ে বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের শেয়ার ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো কিছু জানেন না বলে জানান।
পাশাপাশি একই বিষয়ে কোম্পানি সেক্রেটারি অঞ্জন মল্লিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বিকনের অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে জানান।
প্রসঙ্গত, ২০০১ সালে বিকন ফার্মার যাত্রা শুরু। ২০০৬ সালে উৎপাদন শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির প্রাথমিক পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ছিল ৬০ কোটি টাকা। এরপর ২০০৯ সালে প্রি-আইপিও প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ১৩০ কোটি টাকা মূলধন সংগ্রহ করে বিকন। এরপর ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার মাধ্যমে আরো ৩০ কোটি টাকা উত্তোলন করে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে বিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩১ কোটি টাকা। আর অনুমোদিত মূলধনের পরিমাণ ২৫০ কোটি টাকা।
বিকন ফার্মাসিটিক্যালসের ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ৫০০টি শেয়ারে একটি মার্কেট-লট। বিকন ফার্মার বর্তমান শেয়ারদর ২৪ দশমিক ৬ (১৫ মার্চ) টাকা। কোম্পানির বেসিক মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) ৬৮ দশমিক ৩৩।
জানা গেছে, বিকন ফার্মাসিটিক্যালসের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ এবাদুল করীম, এক্সিকিউটিভ ভাইস-প্রেসিডেন্ট (হিউম্যান রিসোর্স ও অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) শেখ এনায়েত করীম, ভাইস-প্রেসিডেন্ট (মার্কেটিং) এ কে এম আনোয়ারুল হক ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট (কোয়ালিটি অপারেশন) মো. জাকির।