ওষুধ খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি লিবরা ইনফিউশনস লিমিটেডের জমি, ভবন ও মেশিনারিজ নিলাম প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক। কোম্পানির কাছ থেকে পাওনা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ১ অক্টোবর বন্ধকি সম্পদ বিক্রি করে অর্থ আদায়ের জন্য নিলামের উদ্যোগ নেয় ব্যাংকটি। তবে উচ্চ আদালতের আদেশে নিলাম প্রক্রিয়াটি স্থগিত করতে হয় তাদের। স্টক এক্সচেঞ্জ মারফত গতকাল বিনিয়োগকারীদের এ তথ্য দেয় লিবরা ইনফিউশনস।
জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত লিবরা ইনফিউশনসকে মোট ৬০ কোটি ২৮ লাখ টাকা ঋণ দেয় আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক। কারখানার প্রথম ইউনিটের চলতি মূলধন ও দ্বিতীয় ইউনিট সম্প্রসারণের জন্য এ ঋণ নেয় লিবরা ইনফিউশনস। তবে ঋণ নিয়ে নির্ধারিত সময়ে সম্প্রসারণ সম্পন্ন করতে পারেনি তারা। এ সময়ে সে ঋণের বিপরীতে নির্ধারিত কিস্তি পরিশোধেও ব্যর্থ হয় কোম্পানিটি। ফলে চলতি বছরের ১৮ আগস্ট পর্যন্ত লিবরা ইনফিউশনসের কাছে কম্পোজিট বিনিয়োগ সুবিধার আওতায় আসল, মুনাফা ও অন্যান্য চার্জসহ আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের পাওনা দাঁড়ায় ৮৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ব্যাংকের পক্ষ থেকে একাধিকবার ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের সুযোগ দেয়া হলেও তা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় কোম্পানি। এ অবস্থায় বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পেতে লিবরা ইনফিউশনসের বন্ধকি সম্পদ নিলামে তুলতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ব্যাংকটি। গতকাল ১৯ অক্টোবর নিলামের দিন ধার্য ছিল।
এদিকে কোম্পানির সম্পদ নিলামে তোলার নোটিস পেয়ে তা স্থগিতে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন লিবরা ইনফিউশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. রওশন আলম। গত ২১ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালত স্থায়ী সম্পত্তি নিলামে আল-আরাফাহ্ ব্যাংকের নোটিসের কার্যকারিতার ওপর ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেন। একই সঙ্গে রুল জারি করেন আদালত। লিবরা ইনফিউশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ তথ্য বণিক বার্তাকে জানান।
উচ্চ আদালত নিলাম প্রক্রিয়ায় স্থগিতাদেশ দিলেও ১ অক্টোবর লিবরা ইনফিউশনসের বন্ধকি স্থাবর সম্পত্তি বিক্রির উদ্দেশ্যে নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক। আদালতের আদেশের কপি হাতে না পাওয়ায় নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় বলে জানান ব্যাংকটির কোম্পানি সচিব (চলতি দায়িত্ব) মো. মোফাজ্জল হোসেন। অবশ্য পরবর্তীতে ১৪ অক্টোবর পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পুরো নিলাম প্রক্রিয়াটি স্থগিত করে ব্যাংক।
আল-আরাফাহ্ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালে লিবরা ইনফিউশনস কারখানা সম্প্রসারণের ঘোষণা দেয়। ব্যাংকঋণের মাধ্যমে দ্বিতীয় ইউনিট চালুর উদ্যোগ নেয় কোম্পানিটি। অর্থ সংস্থানে আল-আরাফাহ্ ব্যাংকের সঙ্গে তাদের ঋণচুক্তি হয়। চুক্তির অংশ হিসেবে সে সময় অগ্রণী ব্যাংকে কোম্পানির ২০ কোটি ৭৫ লাখ টাকার ঋণও টেকওভার করে আল-আরাফাহ্ ব্যাংক। পরবর্তীতে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কোম্পানিকে ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড মিলিয়ে মোট ৬০ কোটি ২৮ লাখ টাকার ঋণ দেয়া হয়। তবে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতায় কোম্পানিটি পরবর্তীতে খেলাপি হয়ে পড়ে।
ব্যাংক কর্তৃপক্ষের দাবি, লিবরা ইনফিউশসনসকে ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের জন্য একাধিকবার সুযোগ দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্ধারিত হারে ডাউন পেমেন্টসাপেক্ষে পুনঃতফসিলীকরণের সুযোগ দেয়া হয়। তবে কোম্পানি সে সুযোগ না নেয়ায় ১ অক্টোবর অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩ (সংশোধনী-২০১০) এর ১২ ধারা অনুযায়ী বন্ধকি স্থাবর সম্পত্তি নিলামে বিক্রির লক্ষ্যে দরপত্র আহ্বান করে ব্যাংক।
আল-আরাফাহ্ ব্যাংকের কাছে গত ১৮ আগস্ট পর্যন্ত লিবরা ইনফিউশনসের দেনা দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ৪৬ লাখ ৫২ হাজার ৩৩১ টাকা। বকেয়া এ অর্থ আদায়ে ব্যাংকটি রূপনগর শিল্প এলাকায় কোম্পানির ১৬৯ শতাংশ জমি ও জমির ওপর তিনটি বহুতল ভবন ও কারখানার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বিক্রির উদ্যোগ নেয়।
এদিকে গত বছর আল-আরাফাহ্ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ৯০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ জানায় লিবরা ইনফিউশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সে পত্রে আল-আরাফাহ্ ব্যাংকের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিনিয়োগ সুবিধা না দেয়া ও সময়মতো এলসি ছাড় না করার অভিযোগ আনা হয়েছে। কোম্পানির দাবি, এ কারণে তাদের পণ্য উৎপাদন ও কারখানার সম্প্রসারণ ব্যাহত হয়। ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণে কোম্পানি বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে উল্লেখ করে এ ক্ষতিপূরণ দাবি করে লিবরা ইনফিউশনস।
কোম্পানির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি তদন্ত করে এবং এ বিষয়ে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যাখ্যা চেয়ে পাঠায়। ব্যাংকের বক্তব্যের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে ঋণ আদায়, মঞ্জুর ইত্যাদি ব্যাংকের নিজস্ব এখতিয়ারভুক্ত। ব্যাংককে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়।
আল-আরাফাহ্ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগপত্রই নয়, আল-আরাফাহ্ ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও দায়ের করেছে লিবরা ইনফিউশনস কর্তৃপক্ষ।
আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত লিবরা ইনফিউশনস ১৯৯৪ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। রাজধানীর রূপনগর শিল্প এলাকায় প্রায় দুই একর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত এ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ২০১৪ সালে কোম্পানির কর-পরবর্তী মুনাফা ছিল ৭৪ লাখ টাকা। পাঁচ বছর ধরে কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের ২০ শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ দিয়ে আসছে।
২০১৫ হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে এ কোম্পানির কর-পরবর্তী মুনাফা হয় ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও শেয়ারপ্রতি আয় ২ টাকা ১২ পয়সা।