গভীর সংকটে নিপতিত হয়েছে দেশের দুই পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)। গত ১০ মাস ধরে নেওয়া সরকারের নানামুখী পদক্ষেপও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারেনি এ দুই পুঁজিবাজারে। এই সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজার স্থিতিশীল করতে ১০ দফা সুপারিশ করেছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা।
তারা মনে করছেন, পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য এ পর্যন্ত গ্রহীত পদক্ষেপগুলোর পাশাপাশি এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে সব দিক দিয়েই ভালো হবে।
এসব সুপারিশের মধ্যে তারা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) নেওয়া পদক্ষেপগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ যেমন দিয়েছেন, তেমনি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আমানতের ১০ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা দরকার বলেও মত দিয়েছেন।
এছাড়া অতিরিক্ত প্রিমিয়াম কমানো, ব্যাংকের সুদের হার নমনীয় করা, বাজারে আসার আগে বিনিয়োগকারীদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, বিমা কোম্পানিগুলোর লাইফ ফান্ডের টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ, ভালো কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা ও মার্জিন লোন নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণেরও সুপারিশ করেছেন তারা।
এক, এসইসি’র পদক্ষেপ দ্রুত বাস্তবায়ন: পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা।
তারা মনে করছেন, এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন না করলে বাজারে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়বে না। কিন্তু এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে তা কেটে যাবে।
এসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এসইসি যে পদক্ষেপ নিচ্ছে তা দ্রুত কার্যকর করতে হবে। কারণ, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেওয়া পদক্ষেপই যদি বাস্তবায়ন না হয় তাহলে বিনিয়োগকারীদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তাই এসইসি’র পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করা জরুরি।
দুই, আমানতের ১০ শতাংশ বিনিয়োগ: বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) এক হাজার কোটি টাকার ফান্ড গঠন করেছে। এই ফান্ড দ্রুত বাজারে নিয়ে আসতে হবে। পর্যায়ক্রমে তা বাড়াতে হবে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) ঘোষিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আমানতের ১০ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে বাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়বে। এর ফলে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং বিনিয়োগকারীরা আস্থাশীল হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যদি আই মেনে তাদের আমানতের ১০ শতাংশ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে তাহলে তা বাজার স্থিতিশীলতায় যথেষ্ঠ ভূমিকা রাখবে।‘
তিনি বলেন, ‘বাজারে এ মুহূর্তে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোই প্রধান কাজ। এজন্য বাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়াতে হবে। ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ এ সমস্যার সমাধান দিতে পারে।
তিন, অতিরিক্ত প্রিমিয়াম কমানো: অনেক দুর্বল মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি অতিরিক্ত প্রিমিয়াম নিচ্ছে। ফলে শেয়ার অতিমূল্যায়িত হয়ে যাচ্ছে। তাই যে সব কোম্পানি প্রিমিয়াম নিয়ে পুঁজিবাজারে আসছে তাদের মৌলভিত্তি দেখে প্রিমিয়াম নির্ধারণ করতে হবে, যাতে ওইসব কোম্পানি অতিরিক্ত প্রিমিয়াম নিতে না পারে।
অতীতে অনেক দুর্বল মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি অতিরিক্ত প্রিমিয়াম নিয়েছে। পরবর্তীতে কোম্পানিগুলোর শেয়ার অতিমূল্যায়িত হয়ে যায়। ফলে অতিমূল্যায়িত শেয়ার কিনে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ ও ডিএসইর সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানি যাতে অতিরিক্ত প্রিমিয়াম নিতে না পারে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন প্রয়োজনে রি-অডিট করতে হবে। তাদের শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস), মুনাফা, দায় যাচাই- করে প্রিমিয়াম দেওয়া যায় কি না তা বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী ও সংশ্লিষ্ট কোম্পানি উভয়ের স্বার্থ দেখতে হবে।
চার, ব্যাংকের সুদের হার নমনীয় করা: বাজারে মন্দাবস্থা না কাটার আরেকটি বড় কারণ ব্যাংকগুলোর উচ্চ সুদের হার। এ কারণে বিনিয়োগকারীদের বড় একটি অংশ ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছেন। পাশাপাশি পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট আরো কমছে।
এ প্রসঙ্গে শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংক সুদের হার কমিয়ে নমনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। তাহলে পুঁজিবাজারের দিকে বিনিয়োগকারীরা বেশি করে ঝুঁকবেন। বাজারেও স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরে আসবে।’
পাঁচ, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা: পুঁজিবাজারে যে কেউ এসেই বিনিয়োগ করতে পারে না। এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও ধারণা না থাকলে শুধু গুজবে কান দিয়ে ব্যবসা করলে তার ফলাফল খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক। তাই এ ব্যবসার জন্য বিনিয়োগকারীদের দরকার প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও যথাযথ প্রশিক্ষিত হওয়া। এজন্য শেয়ারবাজারে আসার আগে বিনিয়োগকারীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া অত্যাবশ্যক।
অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান বলেন, ‘পুঁজিবাজারে আসার আগে যে কোনো বিনিয়োগকারীর যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কারণ বিনিয়োগকারীদের যদি বাজার সম্পর্কে ধারণা না থাকে তাহলে বাজারে তার প্রভাব পড়া স্বাভাবিক। তাই সরকারি বা বেসরকারি যে কোনো মাধ্যম থেকেই তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’
ছয়, লাইফ ফান্ডের টাকা বিনিয়োগ: বীমা কোম্পানিগুলোর লাইফ ফান্ডের ১৫ হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। সেগুলো বাজারে এলে তারল্য সংকট কাটবে এবং এর প্রভাব পড়বে বাজারে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, ‘বীমা কোম্পানিগুলোর লাইফ ফান্ডের টাকা বাজারে বিনিয়োগ করলে বাজার অনেকটা ঊর্ধ্বমুখী গতি ফিরে পাবে। পাশাপাশি তা তারল্য সংকট কাটাতে ও বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে বড় ভূমিকা রাখবে।
সাত, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা: পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতায় বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ তাদের অংশগ্রহণ বাড়লে বাজারে তারল্য বাড়বে। এতে বিনিয়োগকারীদের হারানো আস্থা ফিরে আসবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, ‘বাজারের এ সংকটাপন্ন সময়ে ব্যাংকিং খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। কারণ আগের অর্থবছরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রচুর মুনাফা করেছে।’
তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর শেয়ারের দাম এখন অনেক কমে গেছে। তাই এসব শেয়ার কিনলে তারা লাভবান হবেন এবং বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।’
এসবের পাশাপাশি নন ব্যাংকিং ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ বাড়ানোর কথাও বলেন তিনি।
আট, দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করা: পুঁজিাবাজারে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ
করতে হবে। কারণ দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ না করলে বাজারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখা যাবে না।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সভাপতি ফখর উদ্দিন আলী আহমেদ বলেন, ‘বাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করতে হবে। বিনিয়োগের মেয়াদ কমপক্ষে পাঁচ বছর স্থায়ী হতে হবে।’
নয়, সরবরাহ বাড়ানো: পুঁজিবাজারে বর্তমানে ভালো শেয়ারের সংকট রয়েছে। তাই বিনিয়োগকারীরা দুর্বল মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির শেয়ার কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই অবস্থায় আইপিওর মাধ্যমে ভালো কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা জরুরি। এতে শেয়ারের দাম অতিমূল্যায়িত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ সাজিদ হোসাইন বলেন, ‘বাজার স্থিতিশীলতায় বাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ারের চাহিদা সবসময় রয়েছে। তাই বাজারের এই অবস্থায় ভালো কোম্পানির শেয়ার আনতে হবে। এতে নতুন নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে আসবে। তবে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) ব্যাপারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ দেখতে হবে আগে। বিনিয়োগকারীরা মুনাফা না পেলে বাজারের প্রতি তাদের কোনো আস্থা থাকবে না।
দশ, মার্জিন লোন: মার্জিন লোন নিয়ে অনেক বিনিয়োগকারী তাদের আম ছালা দুটোই হারাতে বসেছেন। একদিকে মার্জিন ঋণের সুদের টাকা পরিশোধের চাপ ও অন্যদিকে শেয়ারের দরপতন। দুদিক সামলাতে গিয়ে তাদের অবস্থা নাজুক।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদেও সভাপতি মিজান উর রশীদ চৌধুরী বলেন, ‘যেসব বিনিয়োগকারী মার্জিন লোন নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের ব্যাপারে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যাতে করে তারা ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেন। কারণ এ মুহূর্তে মার্জিন লোনের কারণে বিনিয়োগকারীরা ফোর্স সেলের শিকার হচ্ছেন। তাই এর একটি সুষ্ঠু সমাধান করা উচিত।’
শেয়ারবাজারে মন্দা কাটাতে এসইসি সম্প্রতি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে ও কিছু পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করছে। পাশাপাশি আইনি সংস্কারের বিষয়েও কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বুক বিল্ডিং পদ্ধতি সংশোধনের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। একই সঙ্গে রাইট ইস্যু নীতিমালা-২০০৬ এর সংশোধনী চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়াসহ মিউচুয়াল ফান্ড নীতিমালা, প্লেসমেন্ট নীতিমালা, লেনদেন নিষ্পত্তির সময়সীমা টি+২ এ নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত অনুমোদন দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
আইনগত জটিলতা দূর করতে ১৯৯৬ অধ্যাদেশ সংস্কারের কাজ চলছে। পাশাপাশি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন ১৯৯৩ সংশোধনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ডিএসইর সাধারণ সূচক ৮ হাজার ৯১৮ পয়েন্টে উঠে আসে। যা দেশের পুঁজিবাজার ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেকর্ড। এরপরেই পড়তে থাকে সূচক যার ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি ভয়াবহ ধস নামে। ওইদিন লেনদেন শুরু হওয়ার প্রথম ৫০ মিনিটেই ডিএসইর সূচক ৬৩৫ পয়েন্ট পড়ে যায়। এ কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি ওইদিন লেনদেন স্থগিত করে দেয়।