দেশের বৃহত্তম ও প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) নতুন সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন মিডওয়ে সিকিউরিটিজ লিমিটেডের বহুল আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তি সেই রকিবুর রহমান। যার বিরুদ্ধে শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের অভিযোগের অন্ত নেই। বাজার-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে গত ক’দিন ধরে এ নিয়ে চলছে নানা ধরনের নেতিবাচক গুঞ্জন। তাদের প্রশ্ন, যার ব্যাপারে সরকারকে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে তাকে কী করে ডিএসইর সভাপতি পদের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসানো হয়? তাহলে শেয়ারবাজার কি অশুভ চক্রের হাতেই জিম্মি?
গত ১৫ মার্চ পরিচালনা পর্ষদে নির্বাচিত ১২ জন সদস্যের ভোটে ডিএসই’র সভাপতি নির্বাচিত হন রকিবুর রহমান। জানা গেছে, ২০১১ সালে দেশের শেয়ারবাজারে ইতিহাস সৃষ্টি করা ধসের কারণ উদঘাটনে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি যে দু’জন ব্যক্তি সম্পর্কে সরকারকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছিল একজন রকিবুর রহমান তাদেরই একজন। ২০০৯ থেকে ১০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত শেয়ারবাজারকে বেলুনের মতো ফুলিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা নানাভাবে হাতিয়ে নেওয়া হয়।
ডাইরেক্ট লিস্টিং (সরাসরি তালিকাভুক্তি),অগ্রাধিকার শেয়ার, অতিরিক্ত প্রিমিয়াম-মূল্যে তালিকাভুক্তির অনুমোদন ও রাইট শেয়ার ইস্যু করার মাধ্যমে কোম্পানিগুলো বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা তুলে নেয়। দেদারছে চলে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের অনৈতিক ব্যবসা। এসব বিষয়ে রকিবুর রহমানের বড় ভূমিকা ছিল বলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রতিবেদনটি তখনএসইসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল।
এছাড়া শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) তত্কালীন চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকারের নিয়োগ এবং পদত্যাগ করা সদস্য মনসুর আলমের পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে রকিবুর রহমানের বিশেষ ভূমিকার কথা উল্লেখ রয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। আর এসইসিতে বিভিন্ন অনৈতিক কাজের বৈধতা দেওয়ার জন্য জিয়াউল হক খোন্দকার ও মনসুর আলমকে দায়ী করা হয়। তাদের যোগসাজসে ওই সময় এসইসি’র নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কবির ভূঁইয়া এবং এটিএম তারিকুজ্জানসহ প্রত্যেকের বিরুদ্ধে নিবিড় তদন্তের সুপারিশ করে কমিটি। এরই মধ্যে শেয়ারবাজারে অবৈধ কর্মকাণ্ডের জন্য আনোয়ারুল কবির ভূঁইয়াকে বরখাস্ত করে কমিশন। অবশ্য সম্প্রতি মনসুর আলমের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এবং তার ব্যাপারে তদন্ত চলছে। এতসব অভিযোগের পরও ফের ডিএসই’র সভাপতি হলেন রকিবুর রহমান।
১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার ধসের তদন্ত প্রতিবেদনেও রকিবুর রহমান জড়িত ছিল বলে উল্লেখ ছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ডিএসই’র সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে আবারও নতুন করে সে ভীতি তৈরি হয়। বিশেষ করে রকিবুর রহমান ডিএসইর সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সে ভীতি আরও বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষের সেই ভীতি দূর করার নামে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু নীতি গ্রহণ করা হয়। ওইসব নীতির মধ্যে ছিল ব্যাংকের আমানত ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো, সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর করারোপ। এর ফলে সাধারণ মানুষ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে ওঠে। অপরদিকে শেয়ারবাজারে ১৯৯৬ সালের পুনরাবৃত্তি হওয়ার যে কোনো আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেন রকিবুর রহমান। তিনি জোর দিয়ে বলতে থাকেন শেয়ারবাজারে আর কখনোই ’৯৬ সালের মতো ঘটনা ঘটবে না।
তিনি বলেছিলেন, ১৯৯৬ সালের মতো বাজারে এখন জাল শেয়ার নেই। সিডিবিএলের মাধ্যমে লেনদেন হওয়ায় সব ধরনের তথ্য সংরক্ষিত থাকছে। এসইসিও আগের তুলনায় অনেক অভিজ্ঞ এবং সক্রিয়। আর সরকারেরও পুঁজিবাজার নিয়ে বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে। এ কারণে ’৯৬ সালের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই বলে তিনি বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করেন। সরকারের পক্ষ থেকেও এ ধরনের আশ্বাস দেওয়ায় সাধারণ মানুষ কোনো কিছু না বুঝেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। বাড়তি আয়ের আশায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের ঢল নামে। শেয়ারবাজারের দৈনিক লেনদেন ২০০ কোটি টাকা থেকে ৩ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়। অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়ে শেয়ারবাজার। আর যার পরিণতিতে শুরু হয় একের পর এক ধস। নেমে আসে বিপর্যয়। আর এ বিপর্যয় ’৯৬ সালকেও হার মানিয়েছে ২০১১ সালে। সর্বস্বান্ত হয়েছে ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী। পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে আত্মহত্যা করেছেন রনি জামান, হাবিবুর রহমান, লিয়াকত হোসেন ও দিলদার আহমেদ নামক হতভাগা বিনিয়োগকারী। হার্ট অ্যাটাকেও মারা গেছেন কয়েকজন বিনিয়োগকারী। মানসিক যন্ত্রণায় ধুঁকে ধঁকে মরতে বসেছেন আরো হাজার হাজার বিনিয়োগকারী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাজার-সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বিশ্লেষক বলেন, আগের ইতিহাস থেকে বিনিয়োগকারীদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। কোনো মিথ্যা আশ্বাস বা অতি সুন্দর বক্তব্যে প্রভাবিত হয়ে কোনো বিনিয়োগকারীরই বাজারে আসা ঠিক হবে না। বাজার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তারপর তাদের বিনিয়োগে আসা উচিত।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে সোমবার ডিএসইর নতুন সভাপতি রকিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে তা সঠিক নয়।’ তবে তিনি এও বলেন, ‘আমি ফেরেশতা নই। আমি মানুষ। মানুষ হিসেবে আমারও ভুলক্রটি থাকতে পারে। আর ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই আমি ভবিষ্যতে ভালো কিছু করতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘আমাকে একটি সপ্তাহ সময় দিন। একটু অপেক্ষা করুন। বাজারের জন্য আমি ভালো কিছু করতে চাই।আশা করছি, ২০১২ সালেও সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ভালো কিছু করব।’
১৯৯৬ সালে বাজারধসের পর ২০০৯ সালে ডিএসইর সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পরও তিনি এরকম কথা বলেছিলেন। তখন সে ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন, ‘২০০৯ সালে আমি সভাপতি থাকাকালে শেয়ারবাজার তার স্বর্ণালি সময় পার করেছে।’
তার বিরুদ্ধে খন্দকার ইব্রাহিম খালেদের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ইব্রাহিম খালেদ আমার খুব শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তবে সময় হলেই দেখবেন আসলে কে দোষী। শেয়ারবাজার ধসে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হলেই আসল দোষী ব্যক্তিকে চেনা যাবে।বিচারকদের প্রতি আমার যথেষ্ট সম্মান রয়েছে। তারা প্রকৃত দোষীকে বের করতে পারবেন।’
তিনি বলেন, ‘আমি অতি ক্ষুদ্র মানুষ। আমি কোনো মার্চেন্ট ব্যাংক বা বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক নই। আমাকে নিয়ে শুধু শুধুই নানা ধরনের অভিযোগ করা হচ্ছে।’
এ ব্যাপারে এসইসির চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেনের বক্তব্য জানার জন্য মোবাইল ফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।