নির্মাণকর্মীদের দিয়েই জাল বুনছিল জেএমবি

নির্মাণকর্মীদের দিয়েই জাল বুনছিল জেএমবি

একেবারে অজ পাড়াগাঁ যাকে বলে! টালির চাল দেওয়া দরমার ঘর। সামনে মাঠ আর বড় ausydjasdএকটা পুকুর। সেখানে মাছ চাষের বন্দোবস্ত।
বর্ধমানের কাটোয়া মহকুমার এক প্রত্যন্ত গ্রাম। এতটাই যে, বর্ধমান সদর থেকে যাতায়াতের ব্যবস্থা বেশি নেই। সেখানেই জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর প্রথম ঘাঁটি। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের প্রায় এক যুগ আগের ঘটনা। সেই সময়েই ওই গাঁয়ে ১০-১২ জনের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। গোপন বৈঠকও হত।
ঘটনাচক্রে, মঙ্গলকোটে যেখানে জঙ্গি ঘাঁটি হয়েছিল, সেই শিমুলিয়ার মতো কাটোয়া থানা এলাকার ওই গ্রামটিরও নাম শিমুলিয়া! ২০০৫ সালের অগস্টে বাংলাদেশে
পরপর বিস্ফোরণের পরে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হওয়ায় জেএমবি সাময়িক ভাবে তাদের কার্যকলাপ বন্ধ করে দেয়। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, কাটোয়ার ওই গ্রাম থেকে তখনই তারা পাততাড়ি গুটিয়েছিল। পাক্কা ন’বছর পরে, গত বছর ২ অক্টোবর খাগড়াগড়ে জঙ্গিদের ভাড়া নেওয়া বাড়িতে বিস্ফোরণের জেরে ফের জেএমবি-র কার্যকলাপের প্রমাণ মেলে বর্ধমানে। প্রথম দিকে গোয়েন্দারা ধারণা করেন, যাতায়াত ও যোগাযোগের সুবিধা এবং নজরদারি কম থাকাতেই বর্ধমানকে বেছেছে জেএমবি। কিন্তু পরে তাঁদের চোখে পড়ে অন্য একটা ‘নেটওয়ার্ক’যার সঙ্গে বহু নির্মাণকর্মী সরাসরি যুক্ত। কিন্তু সে সব বুঝে ওঠার আগে সেই নেটওয়ার্কের শিকড় এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে তদন্তে নেমে কার্যত হতবাক হয়ে যান গোয়েন্দারা।
গত বছর মে মাসের শেষ দিকে খাগড়াগড়ে হাসান চৌধুরীর বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল শাকিল গাজি (পরে বিস্ফোরণে মৃত)। ২ জুন ওই বাড়িতে পা রাখে এবং জেএমবি-র চাঁই কওসর। পরে বর্ধমান শহরে একটার পর একটা বাড়ি ভাড়া করে তারা। বাবুরবাগ, হাটুদেওয়ান-সহ অন্তত আট জায়গায় বাড়ি ভাড়া করা হয়। তিনটে বাড়িতে ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে জেএমবি সদস্যেরা ছিল। পরে খাগড়াগড় থেকে বাবুরবাগে চলে যায় কওসর। শাকিলের সঙ্গে যোগ দেয় সুবহান মণ্ডল (বিস্ফোরণে মৃত) আর আব্দুল হাকিম এবং তাদের পরিবার।
এক এনআইএ কর্তা বলেন, ‘সুবহানও অন্য জায়গায় থাকার জন্য বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল। হাটুদেওয়ানে কওসর একটি বাড়ি ভাড়া করে। সেখানে তার শ্যালক কদর সপরিবার ছিল বলে জানা গিয়েছে। এ ভাবেই ক্রমশ বর্ধমান শহর জুড়ে আস্তানা গাড়ছিল জেএমবি-র চাঁইরা।’
বর্ধমানে জঙ্গি কার্যকলাপের হদিস মেলার পরে গোয়েন্দারা যে প্রথমে যোগাযোগের সুবিধাকে কারণ বলে ধরেছিলেন, তার সঙ্গত কারণ আছে। বর্ধমান থেকে কলকাতা বা ঝাড়খণ্ড যাওয়া যেমন সুবিধার, খুব সহজে মুর্শিদাবাদ বা নদিয়াতেও যাওয়া যায়। মোটরবাইকে দু’-আড়াই ঘণ্টার মধ্যে কেতুগ্রামের ফুটিসাঁকো হয়ে সীমান্তবর্তী এলাকায় পৌঁছন সম্ভব। এনআইএ-র এক কর্তার মতে, ‘বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মুর্শিদাবাদ বা নদিয়ায় কেন্দ্রীয় ও রাজ্য গোয়েন্দাদের কড়া নজর থাকায় জঙ্গি সংগঠনটি বর্ধমানে ঘাঁটি গাড়ছিল। বিস্ফোরক তৈরির কাঁচামালও বর্ধমান শিল্পাঞ্চল, বীরভূমের পাথর খাদান বা কলকাতা থেকে জোগাড় করার সুবিধা ছিল।’ যেমন, পাথর খাদানে ছোট বিস্ফোরণ ঘটাতে জিলেটিন স্টিক বহুল ব্যবহৃত। বীরভূমের পাথর খাদান এলাকাতেই তো বাড়ি খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণে আহত আব্দুল হাকিমের!
কিন্তু পরে গোয়েন্দাদের সামনে আরও একটি নকশা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে। তা হল, অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজনদের অনেকেই কোনও না কোনও ভাবে নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত। বাদশাহী রোডের রেজাউল করিম, মালদহের কালিয়াচকের হাবিবুর রাজমিস্ত্রির কাজে যুক্ত ছিল। মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া মাদ্রাসার পরিচালক মহম্মদ ইউসুফ, মুর্শিদাবাদের নমোচাঁদার শেখ ওয়াব, লালগোলার লাদেনরাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নির্মাণকাজে যুক্ত ছিল।
এই নির্মাণকর্মীদের বেশির ভাগই দরিদ্র, স্বল্পশিক্ষিত। কিন্তু পেশাগত কারণে বিভিন্ন মানুষের তাঁদের যোগাযোগ হয়। স্থানীয় লোকেদের মাধ্যমে তাঁরা পরিচিত হন, এলাকা নিয়ে খুঁটিনাটি জানতে থাকেন। ফলে তলায়-তলায় জনসংযোগ গড়ে তোলা, নাশকতার জন্য লোক জোগাড় করা তাঁদের পক্ষে সহজ। এনআইএ-র এক কর্তা বলেন, ‘জেএমবি পরিকল্পনা করেই এই নেটওয়ার্ক তৈরি করে। নিরাপদ বর্ধমানকে কেন্দ্র করেই তারা ঘুঁটি সাজাচ্ছিল।’
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা।

Featured আন্তর্জাতিক