প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টির এই সুসজ্জিত ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি যে কতটা অসহায়ত্বের তা সরাসরি অবলোকন না করলে বুঝা মুশকিল। ঈদের ছুটিতে কয়েকদিন আগেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছিল বিরাণ ভূমি। ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ালেও মনে হত জাবিতে কোন বন্ধু কিংবা স্বজন নেই। জীবনটা এমনিই আসা যাওয়া, শূন্যতা-পূর্ণতা দিয়ে গড়া।
অথচ ঈদের ছুটি শেষ হতেই শিক্ষার্থীদের আনাগোনায় আবারও জমে উঠেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্ণকাঠির উদ্যান। এতে জাবি ফিরে পেয়েছে তাঁর আগের সেই চিরচেনা রূপ। তাই ঈদ পরবর্তী প্রাণের ক্যাম্পাস জানবিবিও এখন জমে উঠেছে শিক্ষার্থীদের উদ্দাম নৃত্য আর প্রাণের উচ্ছ্বাসে। যেন ঈদের আনন্দ শেষ হতে না হতেই আরেক আনন্দ এসে হাজির।
পরিবার ছেড়ে থাকার যে কষ্ট তা যেন এক মুহূর্তে মেলান হয়ে যায় বন্ধুদের সাথে দেখা হওয়ার পর। কোথাও কোথাও বন্ধুদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক ঈদ পুনর্মিলনীও হচ্ছে হাসি-খুশি মনে।
আড্ডাবাজদের উপস্থিতিতে আড্ডা গল্পে মুখরিত হয়ে উঠছে গুরুত্বপূর্ণ স্পটগুলো। আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, চাকরিসহ আরও অনেক ইস্যু। এতোদিন ক্যাম্পাস থেকে দূরে থাকার শোধ যেন একদিনই মিটিয়ে নিচ্ছে কড়ায় গন্ডায়। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের পদচারণায় আর আড্ডায় পুনরায় মুখরিত হয়ে উঠেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চ, ছায়ামঞ্চ, টিএসসি, মুরাদ চত্বর, মুন্নি চত্বর, টারজান পয়েন্ট, লাভ আইল্যান্ড, ছবির হাট, জুবায়ের স্মরণী, কবির স্মরণী, শহীদ মিনারের পাদদেশ, সবুজ ঘাস বেষ্টিত বিশাল খেলার মাঠ আর মিঠা পানির লেকের ধার। ঝুপড়ি এবং ক্যাফেটেরিয়ার চিপায়ও চলছে আড্ডা ধুমছে।
এ বিষয়ে ফার্মেসী বিভাগের শিক্ষার্থী অনিক বলেন, অনেকদিন পর সবাই আবার এক হলাম। বেশ ভালো লাগছে। তাই আড্ডা জমছে দারুণ। এই আড্ডা আমাদের প্রাণশক্তি। যা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বতন্ত্র রূপ দিয়েছে। আড্ডায় এলে সারাদিনের সব ক্লান্তি এক নিমিষেই দূর হয়ে যায়।
আবাসিক হলগুলোতেও শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি। প্রতিটি রুমেই লক্ষ করা গেছে শিক্ষার্থীদের কোলাহল। অনেকদিন শূন্য পড়ে থাকা টিভি রুম, রিডিং রুম, ডাইনিং, ক্যান্টিন আর মেসগুলো এরই মধ্যে ভরে গেছে কানায় কানায়। জমে উঠেছে হলের ছোট ছোট খাবারের দোকানগুলোও। দীর্ঘ বন্ধের স্থবিরতা কাটিয়ে আরও নতুন উদ্যোমে বিভিন্ন সংগঠন তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। বিকেলে ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র ও জহির রায়হান অডিটোরিয়ামে নিয়মিত বসছেন জাবির সাংস্কৃতিক সংগঠন : জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার, জলসিঁড়ি, ধ্বনি; বিতর্ক সংগঠন: জুডো, সার্স; মানবতাবাদী সংগঠন: সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর; সাংবাদিকদের সংগঠন: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (জাবিসাস) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবের সদস্যরা।
ওদিকে চাঁদনী রাতে ফজিলাতুন্নেছা হলের পাশে সান বাঁধানো পুকুর ঘাটে গানের আসরও জমজমাট। এ গানের আসরে লালন, শিরোনামহীন, আর্টসেল, ওয়ারফেইজ আর সোলসের গান থেকে শুরু করে ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, আধুনিক গানসহ সব ধরনের জনপ্রিয় গানই স্থান পায়।
এ আসরের অন্যতম গায়ক সাংবাদিকতা বিভাগের বাপ্পী বলেন, ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় আসরটা স্থিমিত হয়ে পড়েছিল। এখন আবার জমে উঠেছে। শিক্ষার্থীরা যেন নিজের প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরে এসে নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সকলের চোখে মুখে সেই আনন্দের প্রকাশ দৃশ্যমান। ক্যাম্পাসের এই সজীবতা হৃদয়কে আলোড়িত করে সকল শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীদের। আর এই উচ্ছ্বাসের উদাস সুরে দূর থেকে ভেসে আসছে-
আরও একটু দূরে, কোন পথ হারা সুরে
তুমি এক ভবঘুরে ঘুরবেই।
কোন ক্লান্ত দুপুরে, এই ব্যস্ত শহরে
জানি ঘুম ভেঙ্গে ঘরে ফিরবেই….।