অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরে বিভিন্ন খাতে দেওয়া সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ শেষ পর্যন্ত ৪০ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকতে পারে, যার একটি অংশ আগামী অর্থবছরের বাজেট থেকে পরিশোধ করতে হবে।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এর ফলে চাপের মধ্য দিয়েই শুরু হবে নতুন অর্থবছর। এতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলাও দেখা দিতে পারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অর্থমন্ত্রী বাজেটে ভর্তুকির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিলেন, এখন দেখা যাচ্ছে, তার থেকে ভর্তুকি অনেক বেশি হবে। এতো অর্থ চলতি বাজেট থেকে সংস্থান করা সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে তিনি আগামী বাজেট থেকে তা শোধ করার ঘোষণা দিয়েছেন।”
এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে দেড়-দুই বছর পর যে সরকার আসবে তাদের কাঁধেও দায় চাপতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেন তিনি।
অর্থমন্ত্রী রোববার জাতীয় সংসদে চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) বাজেট বাস্তবায়ন অগ্রগতি সংক্রান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।
চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় ব্যয় বেড়েছে উল্লেখ করে তাতে তিনি বলেন, ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে ভর্তুকি খাতে ব্যয় ছিল যথাক্রমে জিডিপির ১ দশমিক ১ ও ২ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছিল জিডিপির ২ দশমিক ৩ শতাংশ বা ২০ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। কিন্তু এই অর্থবছর শেষে ভর্তুকি বেড়ে দাঁড়াবে জিডিপির ৪ দশমিক ৩ শতাংশ বা ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
এর মধ্যে ৩ দশমিক ২ শতাংশ চলতি অর্থ বছরেই বরাদ্দ করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বাকি ১ দশমিক ১ শতাংশ আগামী অর্থবছরে পরিশোধের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে অর্থমন্ত্রী জানান।
বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থা থেকে আসা বিপুল পরিমাণ ভর্তুকির দাবি বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় দ্বিগুণ উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, “এর ফলে সংশোধিত বাজেটে সম্ভাব্য ঘাটতি ৪৫ হাজার ২০৫ কোটি টাকা (জিডিপির ৫ শতাংশ) থেকে বেড়ে ৪৬ হাজার ৩২৮ কোটি টাকায় (জিডিপির ৫ দশমিক ১ শতাংশ) গিয়ে দাঁড়াতে পারে।”
ভর্তুকির চাপ কমানো এবং সরকারি ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার উদ্দেশ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সরকার পর্যায়ক্রমিকভাবে মূল্য সমন্বয়ের পরিকল্পনা নিয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী জানান।
গতবছর সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম চার দফা বাড়ায় সরকার। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম সর্বশেষ বাড়ে গত ১ ফেব্র“য়ারি।
মুহিত বলেন, “জ্বালানি খাত থেকে উৎসারিত বাড়তি ভর্তুকি ব্যয়ের কারণে এবং স¤প্রসারণশীল রাজস্ব খাতের প্রসারে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি, লেনদেনের ভারসাম্যে অস্থিরতা, বেসরকারি খাতে ঋণ সংকটসহ সার্বিক অর্থনীতির উপর সম্ভাব্য চাপ বিবেচনা করে ব্যয় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরের বাজেটে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৬৩ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) মোট ব্যয় হয়েছে ৬২ হাজার ৭৬ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় মোট ব্যয় বেড়েছে ৫৭ দশমিক ৭ শতাংশ। বর্ধিত ভর্তুকির কারণে অনুন্নয়ন ব্যয় বাড়ায় মোট ব্যয় বেড়েছে বলে অর্থমন্ত্রী প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন।
আজিজুল ইসলাম বলেন, “অর্থমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন জ্বালানি তেল খাতে বাড়তি ভর্তুকি অর্থনীতিতে চাপ ফেলছে। সেই চাপ আগামী অর্থবছরের জন্য সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সে কারণে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, চাপের মধ্য দিয়েই শুরু হবে নতুন অর্থ বছর।”
সরকার জ্বালানি তেলের দাম কতটা বাড়াবে তার ওপরই নির্ভর করবে আগামী অর্থবছরেও মোট ভর্তুকির পরিমাণ কতোটা দাঁড়াবে।”
তিনি মনে করেন, জ্বালানি তেলের দাম যখন-তখন না বাড়িয়ে এমন একটা ব্যবস্থা করা উচিৎ যাতে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে আমাদের স্থানীয় বাজারেও বাড়বে; আবার কমলে এমনিতেই কমে যাবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত মনে করেন, অর্থনীতির চাপের মধ্যে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ বৈদেশিক সাহায্য আশংকাজনকভাবে কমে যাওয়া। তার মতে, “এক দিকে বিশাল অংকের ভর্তুকি, অন্যদিকে কম বিদেশি সাহায্য-অর্থমন্ত্রী (সরকার) হিসাব মিলাতে পারছেন না। সে কারণেই বাধ্য হয়ে এবারের ভর্তুকির একটা অংশ আগামী বছরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।”
প্রতিবেদনে বিদেশি সাহায্য প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, “ডিসেম্বর পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ২৭ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রকল্প সাহায্য খাতে বাস্তবায়নের হার মাত্র ১৭ শতাংশ যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সে কারণেই এডিপির আকার ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কমিয়ে ৪০ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।”