দ্বিগুণ দামে এলপিজি বিক্রির অভিযোগ ডিলারদের বিরুদ্ধে

দ্বিগুণ দামে এলপিজি বিক্রির অভিযোগ ডিলারদের বিরুদ্ধে

রাষ্ট্রায়ত্ত তিন তেল কোম্পানির ডিলারদের অনিয়ম এবং সরকারের যথাযথ নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বাজারে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ দামে। বাসাবাড়িতে নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধ থাকায় এলপিজি কিনতে গিয়ে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে গ্রাহকদের।

গত অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ বিবেচনা করে সরকার গার্হস্থ্য প্রয়োজনে নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়ার বদলে এলপিজির ব্যবহার বাড়ানোর পক্ষে।

জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিনও পেট্রোবাংলার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, গৃহস্থালিতে নতুন করে আর গ্যাস সংযোগ আর দেবে না সরকার। বরং গৃহস্থালিতে এলপিজি ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হবে।

কিন্তু এ উদ্যোগের কার্যকর বাস্তবায়ন দেখা যায়নি গত নয় মাসেও। বরং আবাসিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে জ্বালানি ব্যবহারে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে। বাসায় পাইপলাইনে গ্যাসের জন্য একজন গ্রাহককে যেখানে মাসে সর্বোচ্চ সাড়ে ৪০০ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে, সেখানে এলপিজি ব্যবহার করতে প্রতি সিলিন্ডারে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১৭০০ টাকা।

রাজশাহী নগরীর এলপিজির ডিলার আবু বকর আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সেখানে সরকারি কোম্পানি যুমনাসহ কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানির এলপিজি সিলিন্ডার (সাড়ে ১২ কেজি) বিক্রি করা হচ্ছে ১৫৮০ থেকে ১৭০০ টাকায়।

বরিশালেও বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সিলিণ্ডার বিক্রি হচ্ছে ১৭০০ টাকা দরে। আর সরকারি কোম্পানির গ্যাস সিলিন্ডার ৭০০ টাকায় বিক্রির কথা থাকলেও তা কিনতে ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা লাগছে বলে জানান একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম।

দাম বেশি রাখার কারণ জানতে চাইলে সাতক্ষীরায় যমুনার ডিলার সিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারের কাছ থেকে প্রায় ৭০০ টাকায় সিলিন্ডার পাওয়ার কথা থাকলেও আমাদের কিনতে হয় সাড়ে ৭০০ টাকায়। আমরা সাড়ে ৮ শ’ থেকে ৯ শ’ টাকায় বিক্রি করছি।”

যদিও কামরুল ইসলাম নামে সাতক্ষীরার একজন গ্রহক বলেছেন, ১৫০০ টাকার কমে সেখানে সরকারি কোম্পানির এলপিজি মেলে না।

অতিরিক্ত দামের কারণ হিসেবে বেশি চাহিদা অনুযায়ী সিলিন্ডার না পাওয়ার কথা বলেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি দাবি করেন, সাতক্ষীরার একজন ডিলার প্রতি মাসে ৫ থেকে ৭টির বেশি সিলিন্ডার পান না।

একই ধরনের কথা বলেন বরিশালে যমুনার ডিলার মো মামুন। তার দাবি, তিনি প্রতি মাসে ৭ থেকে ১০টি সিলিন্ডার পান। তার মতো আরো ৩৫ জন ডিলার বরিশালে যমুনার এলপিজি বিক্রি করেন।

“আমাদের সিলিন্ডার নিতে প্রায় ৭০০ টাকা লাগে। আমাদের বলা হয়েছে একশ থেকে দেড়শ টাকা লাভ করা যাবে।”

মামুন এর অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের কথা অস্বীকার করলেও গ্রাহকদের এমন অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করেছেন যুমনা অয়েল কোম্পানির বরিশাল ডিপো ইনচার্জ সাঈদ হাসান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বরিশালে মোট ৩৫ জন ডিলার আছে। তাদের কাছে ৬৭৮ টাকায় সিলিন্ডার বিক্রি করা হয়। তবে তারা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি টাকা নিচ্ছে বলে গ্রাহকরা অভিযোগ করছেন।”

এসব ডিলারের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এনামুল হক গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সংসদে জানান, দেশে এলপি গ্যাস আমদানি, বোতলজাত ও বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া উম্মুক্ত রয়েছে। ফলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের অনুমোদন নিয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এলপি গ্যাস আমদানি করে বোতলজাত ও বাজারজাত করে থাকে।

এ কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা এলপি গ্যাসের বিক্রয় মূল্য নির্ধারণে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বাজার পরিস্থিতি এবং ক্রেতাদের ভোগান্তির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কীভাবে বৈষম্য কমিয়ে আনা যায় তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা চলছে।”

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান আবু বকর সিদ্দিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তিন লাখ টন চাহিদার বিপরীতে বর্তমানে প্রতিবছর সরকারি উদ্যোগে প্রায় ২০ হাজার টন এবং বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় ৮০ হাজার টন এলপিজি আমদানি করা হচ্ছে।

“অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে উৎপাদিত ২০ হাজার টন এলপিজি পাওয়া যাচ্ছে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড ও রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড থেকে।”

দেশে সরকারি পর্যায়ে এলপিজি বোতলজাত করার দুটি কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের প্ল্যান্টের উৎপাদন ক্ষমতা বার্ষিক প্রায় ১৪ হাজার টন। আর সিলেটের কৈলাশটিলা এলপিজিএল প্ল্যান্টের উৎপাদন ক্ষমতা ৭ হাজার টনের মতো।

এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে আরো ৬টি প্ল্যান্টে এলপিজি বোতলজাত করা হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রামে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান টোটালের মালিকানাধীন প্রিমিয়ার এলপিজি প্ল্যান্টের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১৫ হাজার টন। এছাড়া মংলায় ক্লিনহিটের এলপিজি প্ল্যান্টে বছরে ১৫ হাজার টন এবং বগুড়ায় বিওসির প্ল্যান্টে পাঁচ হাজার টন এলপিজি উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে।

দেশীয় প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরার মালিকানাধীন বসুন্ধরা এলপিজির মংলা প্ল্যান্টের উৎপাদন ক্ষমতা ২০ হাজার টন। বগুড়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যুমনা স্পেসটেক জয়েন্ট ভেঞ্চারের মালিকানাধীন এলপিজি প্ল্যান্টের উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় আট হাজার টন। আর মংলায় ১২ হাজার টন উৎপাদন ক্ষমতার একটি এলপিজি প্ল্যান্ট রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সামিটের।

বিপিসির চেয়ারম্যান আবু বকর সিদ্দিক বলেন, “সারাদেশে প্রায় ২ হাজার ২০০ ডিলার রয়েছে, যারা বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানি যমুনা, পদ্মা, মেঘনার কাছ থেকে কিনে প্রতি সিলিন্ডার (সাড়ে ১২ কেজি) এলপি গ্যাস ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করছে।”

প্রতি সিলিন্ডারে বেশি দাম রাখার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “এমন খবর বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া গেছে, তেল কোম্পানিগুলোকে ডিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে ডিলারশিপ বাতিল করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”

বিপিসির চেয়ারম্যান জানান, আমদানি করা এলপিজি বোতলজাত করতে বার্ষিক এক লাখ টন ক্ষমতার দুইটি প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য সরকার ২০১০ সালে একটি পরিকল্পনা নেয়। এর মধ্যে বাগেরহাটের মংলায় একটি এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে চট্টগ্রামের কুমিরায় দ্বিতীয় কারাখানাটি হওয়ার কথা।

পরিকল্পনা অনুযায়ী মংলা প্ল্যান্টের জন্য ডিপিপি প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আর চট্টগ্রামের প্ল্যান্টের ডিপিপি তৈরির কাজ চলছে বলে জানান তিনি।

এছাড়া সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় বার্ষিক দুই লাখ ৪০ হাজার সিলিন্ডার উৎপাদন ক্ষমতার একটি কারখানার স্থাপনের প্রকল্পও অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বিপিসি চেয়ারম্যান জানান।

অর্থ বাণিজ্য