আকস্মিকভাবেই মহাবিপাকে পড়েছেন দেশের লাখ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে গিয়ে তাদের চোখ চড়কগাছ। গত বছর ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে লেগেছে ৯০০ টাকা, এবার খরচ হচ্ছে ১১ হাজার টাকা। এ নিয়ে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে রীতিমতো বচসায় লিপ্ত হচ্ছেন এ ব্যবসায়ীরা।
করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রেড লাইসেন্স ফি বাড়িয়েছে সরকার। এ ক্ষেত্রে তাদের কিছুই করার নেই। ট্রেড লাইসেন্স ফি বৃদ্ধির তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দ্বিগুণ-তিনগুণ নয়, ৩৩ গুণও বেড়েছে কোনো কোনো ট্রেড লাইসেন্সের নবায়ন ফির পরিমাণ। সে সঙ্গে আরোপ করা হয়েছে বিবিধ কর। সম্প্রতি ২০১০ সালের এক প্রজ্ঞাপন দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের বলা হচ্ছে, ওই সময় প্রজ্ঞাপনটি জারি হলেও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায় করা হয়নি।
কাজেই গত পাঁচ বছরের বকেয়া ভ্যাট একসঙ্গে দিতে হবে। আর এটাও দিতে হবে বর্ধিত ফি অনুসরণ করে। এর সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে লাইসেন্সপ্রতি ৫০০ টাকার উৎসে কর। ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে লাইসেন্স নবায়ন না করলে এর সঙ্গে যুক্ত হবে ৩০ শতাংশ হারে সারচার্জ। কেউ ব্যবসা বন্ধ করে ট্রেড লাইসেন্স সারেন্ডার করতে চাইলে তাকেও এসব ফি দিয়ে ব্যবসার ইতি টানতে হবে। অন্যথায় করপোরেশন তার বিরুদ্ধে মামলা করার এখতিয়ার রাখে।
জানা গেছে, প্রতি বছর জুলাই থেকে জুনের মধ্যে সাধারণত ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করে থাকেন ব্যবসায়ীরা। একসঙ্গে একাধিক বছরের ফি জমা দিয়েও কয়েক বছরের জন্য ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করার সুযোগ আছে। ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নবায়নের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এ জন্য ব্যবসায়ীরা সাধারণত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকেই লাইসেন্স নবায়নের জন্য সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার দ্বারস্থ হন। বর্তমানে সেই লাইসেন্স নবায়ন মৌসুমই চলছে।
সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ২ মার্চ স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের ফি বর্ধিত করার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। অনেকটা নীরবেই এটা জারি করা হয়। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় প্রজ্ঞাপনের অনুলিপি পাঠানো হলেও তখন লাইসেন্স নবায়ন মৌসুম না হওয়ায় এ নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করেননি। সম্প্রতি লাইসেন্স নবায়ন করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চোখে অন্ধকার দেখার মতো অবস্থা।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে যান ১৯ ধলপুরের মুদি ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান। তিনি ওই অফিসের কর কর্মকর্তা ইকবাল আহমেদের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে যান। এক পর্যায়ে তিনি ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন না করে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের গালাগাল করতে করতে বেরিয়ে পড়েন। সাইদুর রহমান সমকালের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গতবার তার ট্রেড লাইসেন্স করতে সব মিলে খরচ হয়েছিল ৯০০ টাকা। এবার তার কাছে চাওয়া হচ্ছে ১১ হাজার টাকারও বেশি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইকবাল আহমেদ সমকালকে বলেন, সরকার ট্রেড লাইসেন্স ফি বাড়িয়েছে। অথচ ব্যবসায়ীরা মনে করছেন সরকার ফি বাড়ায়নি। সিটি করপোরেশনের কর্মচারীরা এই অতিরিক্ত টাকা ঘুষ হিসেবে নিচ্ছেন। একবারে এত বেশি মাত্রায় ফি বাড়ার বিষয় কেউ কেউ বুঝতে চাইছেন না।
এদিকে গত ১৬ সেপ্টেম্বর সিটি করপোরেশন থেকে প্রতিটি আঞ্চলিক কার্যালয়ে আরেকটি আদেশ পাঠানো হয়। ওই আদেশের সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একটি চিঠিও সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ২০১০ সালের ৩ জুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জারি করা প্রজ্ঞাপনে ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্সের নবায়নের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য হবে। দীর্ঘ পাঁচ বছর এটা আদায় করা হয়নি। কাজেই বর্তমানে যেসব ব্যবসায়ী ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করবেন, তাদের গত পাঁচ বছরের সমুদয় ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে। সিটি করপোরেশন বর্ধিত লাইসেন্স ফির ওপর এই ভ্যাট যুক্ত করে লাইসেন্স ফি নির্ধারণ শুরু করেছে। ফলে সব মিলিয়ে আকস্মিকভাবে ব্যাপক হারে বেড়ে যাচ্ছে ট্রেড লাইসেন্সের নবায়নের খরচ। এতে ক্ষুব্ধ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল সমকালকে বলেন, সরকার লাইসেন্স ফি বাড়িয়েছে। তবে বেশি চাপ পড়বে ভ্যাট আরোপের কারণে। এ জন্য ভ্যাটের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে তারা ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ব্যবসায়ীরা পর্যায়ক্রমে ভ্যাটের অর্থ পরিশোধ করতে পারবেন।
ট্রেড লাইসেন্স ফি বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, দেশে বিদ্যমান ২৯৮ ধরনের ব্যবসার একটি ছাড়া প্রতিটির ট্রেড লাইসেন্স ফি বাড়ানো হয়েছে। কমেছে মদ ও বেভারেজের আওতায় থাকা পানীয়র ফি। ২০০৩ সালে মদের ব্যবসার লাইসেন্স নবায়ন ফি ছিল সাত হাজার ৫০০ টাকা। এবার সেটা বেভারেজের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করে নবায়ন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। প্রতিটি ট্রেড লাইসেন্স নবায়নে ৫০০ টাকা উৎসে কর যুক্ত করা হয়েছে।
দেখা গেছে, ২০০৩ সালের ট্রেড লাইসেন্স তফসিলে কনফেকশনারির ট্রেড লাইসেন্স ফি ছিল ৩০০ টাকা। এবার সেটা বাড়িয়ে করা হয়েছে দুই হাজার টাকা। কমিউনিটি সেন্টারের ফি করা হয়েছে দুই হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। অটোমোবাইল ওয়ার্কশপের ফি করা হয়েছে ৭৫০ থেকে চার হাজার টাকা। মাছের দোকানির ফি করা হয়েছে ৩০০ থেকে চার হাজার টাকা। সেলুনের ফি করা হয়েছে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকা। স্টুডিও ল্যাবের ফি ৭৫০ থেকে করা হয়েছে দুই হাজার টাকা। মাটির হাঁড়ি-পাতিল বিক্রির ফি করা হয়েছে ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা।
পান-সুপারির দোকানের ফি করা হয়েছে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা। মুরগি বিক্রির ফি করা হয়েছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। তরকারি দোকানের ক্ষেত্রে করা হয়েছে ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা। মুদি দোকানের ফি করা হয়েছে ৩৫০ থেকে এক হাজার টাকা। চায়ের দোকানের ফি করা হয়েছে ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা। লন্ড্রির দোকানের ফি করা হয়েছে ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা। মোটরসাইকেল দোকানের ফি করা হয়েছে তিন হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, ফাস্টফুড দোকানের ফি ছিল ৩০০ টাকা। সেটা করা হয়েছে ১০ হাজার টাকা। এ বৃদ্ধির পরিমাণ ৩৩ দশমিক ৩৩ গুণ।
এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ট্রেড লাইসেন্সের ফি অত্যধিক হারে বাড়ানোর ফলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। নতুন উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। তিনি ট্রেড লাইসেন্সের ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার এবং যুক্তিসঙ্গত হারে ট্রেড লাইসেন্স ফি নির্ধারণের জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানান। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের সময়সীমা বৃদ্ধি করারও দাবি জানান তিনি।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবদুল মালেক বলেন, ট্রেড লাইসেন্সের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের বিষয়ে মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মধ্যে আলোচনা চলছে। এ জন্য একটি কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রয়োজনে ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের সময়সীমা বাড়ানোর আশ্বাস দেন তিনি। সংগৃহীত