নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ১৭ মার্চ শনিবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯২তম জন্মবার্ষিকী পালন করছে দেশ। দিনটি জাতীয় শিশু দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেন শেখ মুজিবুর রহমান। কালক্রমে কার্যত তার হাত ধরেই বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।
সকাল ৭টার পর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে তার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী। এ সময়, সেখানে মন্ত্রিসভার সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।
এরপর শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ প্রধান হিসাবে দলের সভাপতিমণ্ডলীর, কার্যনির্বাহী সংসদ এবং উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের নিয়ে জাতির জনকের প্রতিকৃতিকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
পরে জাতীয় সংসদের স্পিকার আব্দুল হামিদ, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোসহ নেতাকর্মীরা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি।
এদিন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি প্রাঙ্গণে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, শিশু সমাবেশ, আলোচনা সভা এবং গ্রন্থমেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে রোববার বিকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে এক বাণীতে নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বাস্তবায়নের জন্য নতুন প্রজন্মকে সোনার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন এবং জাতীয় শিশু দিবসে বাংলাদেশকে শিশুদের জন্য নিরাপদ আবাসভূমিতে পরিণত করার শপথ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
টুঙ্গিপাড়ায় এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া শেখ মুজিবুর রহমান স্কুলজীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কৈশোরে তার রাজনীতির দীক্ষাগুরু ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে তিনি প্রথমবারের মতো কারাবরণ করেন।
ম্যাট্রিকুলেশন পাসের পর কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতাদের সান্নিধ্যে আসেন শেখ মুজিব। ওই সময় থেকেই নিজেকে ছাত্র-যুবনেতা হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেন, যোগ দেন আওয়ামী মুসলিম লীগে, যা পরে অসা¤প্রদায়িক চেতনা নিয়ে আওয়ামী লীগ নাম নেয়।
বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বারবার কারাগারে যেতে হতে হয়েছে শেখ মুজিবকে। আর আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ তাকে নিয়ে যায় বাঙালির নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগ-প্রধান হিসেবে ’৬৬-এ ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন তিনি, যার পরে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারারুদ্ধ হতে হয় তাকে।
’৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়। ’৭০-এর নির্বাচনে বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের ম্যান্ডেট লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির এ নির্বাচনী বিজয়কে মেনে নেয়নি।
এরপর বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রথমে স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ দেন। ’৭১-এর মার্চে শুরু করেন অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে তার ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাঙালিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে ধাবিত করে।
’৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করার পর রাতেই বন্দি হন শেখ মুজিব। তবে তার আগে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে অন্তরীণ থাকলেও তার নামেই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতিও করা হয় তাকে।
অন্যদিকে স্বাধীনতা ঘোষণা ও বিদ্রোহের অভিযোগ এনে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে গোপন বিচারের নামে প্রহসন শুরু হয় বঙ্গবন্ধু বিরুদ্ধে।
নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় আসে। এরপর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে বঙ্গবন্ধু ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বাধীন ভূমিতে পা রাখেন।
সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের দায়িত্বভার নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, যদিও ওই সময়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র থেমে ছিল না।
আর আওয়ামী লীগের অনেক নেতার কর্মকাণ্ডেরও সমালোচনা ওঠে। আর আন্দোলনের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর যে অভাবনীয় জনপ্রিয়তা ছিল, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে যে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে তিনি পারেননি বলে অনেকেরই মত।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে জাতীয় কর্মসুচি ঘোষণা করেন। গঠন করেন বাকশাল, যার ফলে দেশে অন্য সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়, চারটি সংবাদপত্র ছাড়া অন্য সব সংবাদপত্রও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তার কিছু দিনের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট এক দল সেনা কর্মকর্তার অভ্যুত্থানে নিজ বাসভবনে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য রাজপথ কিংবা কারাগারে যার জীবন কেটেছে, সেই দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে অবসান ঘটে স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়কের এবং তা বাঙালিরই হাতে।