ঢাকা সফরকালে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাওয়াদ জারিফ বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়তে চায় ইরান। বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের জন্য ইরান অন্যতম উৎস হতে পারে। শুধু তাই নয়, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, সংস্কৃতি, ধর্মসহ সার্বিক বিষয়ে ঢাকা-তেহরান শক্তিশালী সম্পর্ক গড়বে।
বুধবার বিকেলে ঢাকার হোটেল সোনারগাঁওয়ে এক সংবাদ সম্মেলন এ তথ্য জানান ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এর আগে সফরের শুরুতে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং বিকেলে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের সঙ্গে সঙ্গে বৈঠক করেন। বাংলাদেশ সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জাওয়াদ জারিফ বলেন, গত জুলাইতে রাশিয়া, আমেরিকা, ব্রিটেন, চীন, ফ্রান্স ও জার্মানির সঙ্গে সই হওয়া পরমাণু চুক্তি সম্পর্কে বাংলাদেশকে অবহিত করতে তিনি এ সফরে এসেছেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও উদার মধ্যপন্থী মুসলিম দেশ। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাদের এই সংগ্রামে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ আমাদের পাশে থেকেছে। তাই সমস্যা সমাধানের পর কীভাবে এই অর্জন হলো, সেটি বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম জনগণ ও সরকারকে জানাতে এসেছি। সেই সঙ্গে ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দুই দেশের জনগণের স্বার্থে সম্পর্ক কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, তা নিয়ে কথা বলতে এসেছি।’
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে মোহাম্মদ জাওয়াদ জারিফ জানান, ব্যবসা-বাণিজ্য, বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগ এবং কর্মী নিয়োগ বিষয়ে অচিরেই দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে। এ ছাড়া সামনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ইরান সফর করবেন। ওই সফরে বেসরকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিও থাকবে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে সংযোগের জন্য সম্ভাব্য খাত নিয়ে বৈঠক করেছি। জ্বালানি, টেক্সটাইল, শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শিক্ষা এবং বেসরকারি খাতের উন্নয়নে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ‘বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং ভিসা ইস্যুসহ পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। ইরান এবং বাংলাদেশের মধ্যে ঐতিহ্যগত সম্পর্ক রয়েছে যা আগামীতে আরও শক্তিশালী হবে।’
ইরান থেকে পাকিস্তান হয়ে ভারত পর্যন্ত যে গ্যাস পাইপলাইন হবে তা থেকে বাংলাদেশ কোনোভাবে উপকৃত হতে পারে কিনা- গণমাধ্যম কর্মীদের এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ জাওয়াদ জারিফ বলেন, ‘ত্রি-দেশীয় গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে ইরান পাকিস্তান এবং ভারতে গ্যাস রফতানি করবে। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে। ওই পাইপলাইন বাংলাদেশ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হতে পারে। এ জন্য দুই দেশের জ্বালানি মন্ত্রণালয় আলাপ-আলোচনা করবে। দুই দেশের মধ্যে এই বিষয়ে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে।’
সিরিয়া ইস্যুতে এক প্রশ্নের জবাবে জাওয়াদ জারিফ বলেন, সিরিয়ার ব্যাপারে ইরানের নীতি স্পষ্ট। আর তা হলো- সিরিয়ার জনগণেরই রয়েছে তার দেশের সমস্যা সমাধানের এখতিয়ার। এজন্য বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার কোন বিকল্প নেই। আর এ নীতি ইয়েমেনের বেলায়ও ইরান গ্রহণ করেছে।
তিনি অভিযোগ করেন, পশ্চিমা দেশগুলো সিরিয়া ও ইয়েমেনসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করেছে। তারা সব সময়ই এসব দেশে সংঘাত ও গৃহযুদ্ধ লেগে থাকুক সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে।
রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গা নির্যাতন কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। রোহিঙ্গাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। তাদের অধিকারের প্রতি সচেতন থাকতে হবে। ইরানের সঙ্গে বৈশ্বিক ফোরামের যে সংযোগ রয়েছে, সেখানে এই বিষয়ে কথা বলবে তেহরান।’
গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সন্ত্রাসের জন্ম দিচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি। তবে শুধু এই একটি কারণে সন্ত্রাসের জন্ম হতে পারে না। এর পেছনে শিক্ষা, আইনের শাসন, দৃষ্টিভঙ্গিসহ অনেক কারণ রয়েছে।’
আইএস’র সমালোচনা করে ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আইএসসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে উস্কে দিয়ে এবং তাদের আবেগকে হঠকারিমূলকভাবে ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছে, যার সঙ্গে প্রকৃত ইসলাম ও মুসলমানদের মোটেই সম্পর্ক নেই। এসব সন্ত্রাসীদের বেশিরভাগেরই মূল শিকড় আমেরিকা ও ফ্রান্সসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে। পশ্চিমারা রাজনৈতিক স্বার্থে এসব গোষ্ঠীকে ব্যবহার করছে যা বন্ধ হওয়া জরুরি।‘
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাওয়াদ জারিফ গত মঙ্গলবার রাতে বাংলাদেশ সফরে আসেন। পরমাণু ইস্যুতে ইরানের সঙ্গে ছয়জাতিগোষ্ঠীর যে সমাঝোতা হয়েছে তা বাংলাদেশকে জানাতেই মোহাম্মদ জাওয়াদ জারিফ ঢাকা সফর করেন। পাশাপাশি সামনের দিনগুলোতে ঢাকার সঙ্গে তেহরানের কী কী বিষয়ে সম্পর্ক উন্নয়ন হতে পারে তারও একটি রুপরেখা এই সফরে ঠিক করা হয়। ২২ ঘণ্টার সফর শেষে বুধবার রাতেই তিনি ঢাকা ছেড়ে যান।- আইআরআইবি