বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করেছে সরকার। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ থেকে সরকারের কোষাগারে জমা হবে বছরে মাত্র ২০০ কোটি টাকা। যদিও প্রতি বছরই বিভিন্ন খাতে বড় অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা ঘটছে। কর ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে টোব্যাকো ও টেলিকমসহ বিভিন্ন খাতের বড় করপোরেটদের বিরুদ্ধে। কোটি টাকা আয় করেও কর দেন না, এমন ব্যক্তির সংখ্যাও নেহাত কম নয়।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) প্রকাশিত প্রতিবেদনমতে, দেশে অনুমোদনপ্রাপ্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে ৮৩টি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ে চার লাখের মতো শিক্ষার্থী রয়েছেন। প্রতি বছর এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মতো আয় করে; যার সিংহভাগই টিউশন ফি হিসেবে আদায় হয়। এর ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয় হবে ২০০ কোটি টাকার মতো।
রাজস্ব আয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন খাতের দিকে নজর না দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভ্যাট আদায়ের এ উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর গুণগত শিক্ষাগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত না করে ভ্যাট আদায়ে প্রচেষ্টা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে বলে মনে করছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আয় বাড়াতে প্রতি বছর নতুন নতুন খাতের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের পরিকল্পনা করে এনবিআর। দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থীই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন। এর মাধ্যমে প্রতি বছর বড় অঙ্কের মুনাফাও করছেন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরা। তাদের আয়ের ওপর কর না বসিয়ে টিউশন ফির ওপর ভ্যাট আরোপ করাটা অনৈতিক।
ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক ড. সাজ্জাদ জহির এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, বৈদেশিক ঋণের শর্তপূরণের পদক্ষেপ হিসেবে যদি ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হয়, তাহলে তার আগে-পিছে ভাবার প্রাথমিক দায়িত্ব সরকারের। শিক্ষার ওপর আগে থেকে পরোক্ষ কর বিদ্যমান ছিল। এখন ভেবে দেখতে হবে, শিক্ষার ওপর ভ্যাটের পরিধি না বাড়িয়ে এগোনো সম্ভব কিনা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি বছর বড় অঙ্কের মুনাফা করে। গুণগত শিক্ষার বিষয়টিতে নজর দিয়ে তাদের মুনাফা অর্জনের পথ বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। সমাজের শিক্ষা ব্যবস্থা এগিয়ে নিতে সরকার পরোক্ষ কর আদায়ের বিষয়ে নজর দিতে পারে।
ইউজিসির সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি নির্ধারণের ক্ষেত্রে একক কোনো কাঠামো নেই। ব্যয় নির্ধারণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি নির্ধারণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে এ টিউশন ফি প্রতি সেমিস্টারে প্রতি ক্রেডিটে ৩ থেকে ৬ হাজার টাকা।
টিউশন ফি আদায়ে নীতিমালাহীনতার মধ্যেই চলতি অর্থবছর থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও মেডিকেল কলেজের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করে সরকার।
এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ বলেন, রাজস্ব আহরণে প্রতি বছরই নতুন নতুন ক্ষেত্র বাড়ানো হয়। সে হিসেবে চলতি বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন যে খাত চিহ্নিত হয়েছে, তা আসলেই ভ্যাটযোগ্য কিনা।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের কর প্রত্যাহারের আন্দোলনের মধ্যে এনবিআর এক বিবৃতিতে জানায়, টিউশন ফির ওপর এ ভ্যাট আলাদা করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হবে না; বরং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরকারকে এ ভ্যাট পরিশোধ করবে এবং বিদ্যমান টিউশন ফির মধ্যে ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত থাকায় টিউশন ফি বাড়ার কোনো সুযোগ নেই বলেও এতে উল্লেখ করা হয়।
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের উচ্চশিক্ষার স্বার্থে টিউশন ফির ওপর আরোপিত সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারে সরকারের কাছে দাবি জানায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি। সংবাদ সম্মেলনে সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে। আর কোনো ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠানের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয় না। ভ্যাট আরোপ করা হয় লাভজনক প্রতিষ্ঠানের ওপর। বিশ্ববিদ্যালয় লাভজনক প্রতিষ্ঠান নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে এ পর্যায়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করেন, তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, যারা এখানে শিক্ষা নেন। যাদের অঢেল অর্থ রয়েছে, তারা বিদেশে পড়াশোনা করেন। যদিও অর্থমন্ত্রী মনে করেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দৈনিক খরচ ১ হাজার টাকা।
তবে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, দেশে বর্তমানে সাড়ে চার লাখের বেশি শিক্ষার্থী ৮৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়ন করছেন; যাদের ৭০ শতাংশই নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের পরিবারের সন্তান। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদেরই শিক্ষার সব ব্যয়ভার বহন করতে হয়।
সূত্র: বণিক বার্তা।