বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিউশন ফি কমানোর বদলে উল্টো সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা শিক্ষা খাতে বেশি ব্যবসার সুযোগ করে দেয়া কি না এমন প্রশ্ন উঠেছে বিবিসি বাংলাদেশ সংলাপে।
একই সঙ্গে সংলাপে আলোচকরা বলেছেন, ভ্যাট আরোপের মাধ্যমে শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা একটা বৈষম্যমূলক আচরণ ও সংবিধান পরিপন্থী। শিক্ষা খাতকে বলি দিয়ে সরকারের আয়ের ব্যবস্থা করা ঠিক নয়।
শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারের টিসিবি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত বিবিসি বাংলাদেশ সংলাপের এই পর্বে প্যানেল আলোচক ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এনাম আহমেদ চৌধুরী, অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সায়েমা হক বিদিশা।
অনুষ্ঠানে প্রথম প্রশ্ন ছিল- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপকে কি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে?
উত্তরে সায়মা হক বলেন, “সরকার হয়তো মনে করছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক বেশি আয় করছে। কিন্তু সেখানে আরোপিত ভ্যাট ভোক্তা অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের ওপরেই বর্তায়। তাই সরকারকে অন্যভাবে ভাবতে হবে।” তিনি বলেন, “বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাভের অংশের ওপর সরকার ভ্যাট বসাতে পারে। আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ফি বেশি নিলে তা কমানোর ব্যবস্থা নিতে পারে ইউজিসি।”
“শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে দেয়া হচ্ছে’ বলে মন্তব্য করেন সায়মা।
এ সময় দর্শক সারির এক তরুণী বলেন, “শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর নয়, ইনকাম ট্যাক্সের ওপর কর আরোপ করা হোক।” আরেকজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলেন, “বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি যেভাবে বাড়ছে, সেটি কমানোর ব্যবস্থা না করে উল্টো সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট আরোপ করে এসব প্রতিষ্ঠানকে বেশি ব্যবসার সুযোগ করে দিচ্ছে না সরকার?”
অপর এক তরুণী বলেন, “ভ্যাট আরোপের মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বা বৈষম্য তৈরি করা হচ্ছে, যা উচিত নয়।”
এনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, “এটা একটা বৈষম্যমূলক আচরণ। শিক্ষা খাত ভ্যাটের জন্য প্রযোজ্য কি না তা বিবেচনা করে দেখা উচিত। এটা সংবিধান পরিপন্থী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাভের অংশ সরকার নিতে চাইলে আরো বহু উপায়ে তা করা যেত। কিন্তু শিক্ষা খাতকে বলি দিয়ে সরকারের আয়ের ব্যবস্থা করা ঠিক নয়। শিক্ষাকে এখানে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।”
মশিউর রহমান বলেন, “যে ফি এখন দিচ্ছে এর মধ্যেই কিন্তু এই ভ্যাট সংযুক্ত আছে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এ টাকা নেয়ার কথা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাভের অংশ কমে যাবে এ আশঙ্কায় হয়তো তারা (বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্র বলেন, “আমি প্রতিদিন বাবার কাছ থেকে ২৫ টাকা হাতখরচ নিয়ে বের হই। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন এক হাজার টাকা খরচ করি। এ তথ্য তিনি কোথায় পেলেন?”
অনুষ্ঠানে আরেকটি প্রশ্ন ছিল, “নতুন ঘোষিত বেতন কাঠামোতে শিক্ষকরা যে বিশেষ সুবিধা দাবি করছেন, তা কতটুকু যুক্তিসংগত বলে আপনারা মনে করেন?”
সায়মা হক বলেন, “বর্তমানে অষ্টম বেতন স্কেলে ২০টি থেকে বাড়িয়ে ২২টি ধাপ করা হয়েছে। শিক্ষকদের ব্যাপারে বেতন ও সম্মান দুটোরই বিষয়। তাদের দাবি যৌক্তিক।”
এনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, “কাউকে কোনো সম্মান দিয়ে তা উঠিয়ে নেয়া উচিত হবে না। শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক।”
দর্শকদের থেকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বলেন, “এখন সিলেকশন গ্রেড বাতিল ও নতুন দুটি গ্রেড করার কারণে শিক্ষকরা তিন ধাপ পিছিয়ে পড়েছেন।”
মশিউর রহমান বলেন, “চাকরি নেয়ার সময় সম্মান আর পরে বেতন- কেন এ মানসিকতার পরিবর্তন সৃষ্টি হচ্ছে তা ভেবে দেখতে হবে। শিক্ষকের সম্মান কিন্তু অন্য মাপের সম্মান।”
ফারাহ কবির বলেন, “শিক্ষকদের সম্মানের জায়গাটা কিন্তু ঠিক করতেই হবে। প্রয়োজনে আজকের বাস্তবতা বিবেচনা করে বিষয়টি রিভিউ করা হোক। ”
রাজনৈতিক ঐকমত্য
অনুষ্ঠানে আরেক প্রশ্ন ছিলো- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম হানাহানি বন্ধ করে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার যে আহ্বান জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মত রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত একটি দেশের বাস্তবতায় তা কি সম্ভব হবে?
উত্তরে মশিউর রহমান বলেন, “যদি আমরা বিশ্বাস করি এ ঐক্য দেশের কল্যাণে আসবে তবে বিবেচনা করে দেখা যোতে পারে। যদি কাজে না আসে, তবে করার কোনো দরকার নেই।”
দেশে রাজাকারদের বিচার হচ্ছে, কিন্তু দুর্নীতির বিচার করা হচ্ছে না, এক দর্শকের এমন মন্তব্যের জবাবে মশিউর বলেন, “রাজকার ও দুর্নীতিকে এক করে দেখা যাবে না।”
এনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, “যার যা প্রাপ্য সেটা তাকে দিতে হবে। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের এ আহ্বানকে আমরা স্বাগত জানাই।”
সায়মা হক বলেন, “আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরমত সহিষ্ণুতার অভাব রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না তা হবে, তত দিন এ ঐক্য আসবে না।”
ফারাহ কবির বলেন, “শুধু অথনৈতিক মূল্যায়ন দিয়ে মধ্য আয়ের দেশ হয়ে গেলে হবে না। সামাজিক ঐক্যও স্থাপন করতে হবে। রাজনীতিক এবং জনগণ সবারই এই ভূমিকা রাখতে হবে।”
জ্বালানি তেলের দাম প্রসঙ্গ
অন্য একজন দর্শকের প্রশ্ন ছিল- বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম পড়লেও বাংলাদেশে তা না কমাতে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা কি সমর্থনযোগ্য?
উত্তরে সায়মা হক বলেন, “এ ধরনের ক্ষেত্রে সরকারকে দেখতে হবে, বিশ্ববাজারের সঙ্গে আমাদের দাম মিলিয়ে রাখাটা যুক্তিযুক্ত।”
ফারাহ কবির বলেন, “সরকারকে রেভিনিউর জায়গা থেকে বঞ্চিত তাদের কথাও ভাবতে হবে। প্রগ্রেসিভ ট্যাক্সেশন প্রয়োজন। মিনিমাম ওয়েজ নির্ধারণ করা দরকার।”
মশিউর রহমান বলেন, “বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেও আমরা দাম বাড়াইনি। সেই ঘাটতি কাটানোর জন্যও এ দাম কমানো যাচ্ছে না।”
ফারাহ কবির বলেন, “যে দেশে দিনে আনে দিনে খায়, সেখানে এভাবে বেশি দাম রাখা উচিত নয়।”
বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশন ও বিবিসি বাংলার যৌথভাবে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি প্রযোজনা করেন ওয়ালিউর রহমান মিরাজ এবং উপস্থাপনা করেন আকবর হোসেন।