মাটি ও মানুষের শিল্পী শাহ আবদুল করিম। একুশে পদকপ্রাপ্ত মহান এ কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বের ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী আজ শনিবার। তিনি ২০০৯ সালের এই দিনে মুত্যবরণ করেন। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে এক কৃষক পরিবারে ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম জন্মগ্রহণ করেন। দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে বেড়ে উঠেন তিনি। আর ছেলে বেলা থেকেই শুরু করেন সঙ্গীত সাধনা। বাউল সম্রাটের প্রেরণা স্থান ছিল তার স্ত্রী আফতাবুন্নেসা। তিনি তাকে আদর করে ডাকতেন ‘সরলা’। স্ত্রীর প্রয়ানের পর সরলাকে নিয়ে গান রচনা করেন তিনি।
বাউল সম্রাট লালন ফকির, হাছন রাজা, রাধারমন, শীতালং শাহ, আরকুম শাহ, দূরবীন শাহ, উকিল মুন্সী, শেখ বানুকে মনেপ্রাণে লালন করে গান বুনেছেন, গান গেয়েছেন। তার রক্ত ও চিন্তা-ভাবনাজুড়ে ছিল দেশপ্রেম, স্বাধীনতা ও মাটির গন্ধ। সে সব গান দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের আনাচে-কানাচে পৌঁছে গিয়েছে।
ভক্ত-অনুরাগীরা গানের মাঝেই খোঁজেন বাউল সম্রাটের মায়াবি মুখ। উজান ধলের কালনীর তীরে বেড়ে ওঠা রাখাল বালক হয়ে উঠেন জনতার গীতিকবি। সমাজ, সংসার থেকে অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার দূর করতে রচনা করেন অসংখ্য গান। তিনি বেঁচে নেই। রেখে গেছেন অসংখ্য গান। তার রচিত গানের মিলে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া। বন্ধুরে কই পাবো সখি গো / তুমি বিনে এ ভুবনে কে আছে ঔষধি রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি….। গানের মাঝেই শ্রষ্টার সান্নিধ্য পাওয়ার চেষ্টায় মগ্ন ছিলেন বাউল আব্দুল করিম। ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার কথাও উঠে এসেছে তাঁর গানে।
অধ্যাত্মিকতার দিক থেকে হাসনরাজা, রাধারমন, ফকির দুরবীন শাহ ও মওলানা ইয়াসিনের আধ্যাত্মিক গানের ভাবার্থের সঙ্গে বেশ মিল রয়েছে বাউল করিমের গানের। কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু/ গানে মিলে প্রাণের সন্ধান/ আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম/ কোন মেস্তরী নাও বানাইছেসহ প্রায় দেড় সহস্রাধিক গান বাউল সম্রাটকে কিংবদন্তির আসনে বসিয়েছে। তাঁর রচিত গানেই ছিল সৃষ্টিকর্তার উপাসনা।
ইতোমধ্যে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে তার ১০টি গান ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। শিল্পীর চাওয়া অনুযায়ী এ বছরের প্রথম দিকে সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের উদ্যোগে বাউল আব্দুল করিমের সমগ্র সৃষ্টিকর্ম নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। কিশোর বয়স থেকে গান লিখলেও আগে এসব গান শুধু ভাটি অঞ্চলের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় ছিল।মৃত্যুর আগে বেশ কয়েকজন শিল্পী বাউল শাহ আব্দুল করিমের গান নতুন করে গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করলে তিনি দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন। প্রয়াত বাউল রুহি ঠাকুর, তার ভাই রমেশ ঠাকুর, বাউল আব্দুর রহমানসহ অসংখ্য গায়েন তৈরি করে গেছেন তিনি।
প্রখ্যাত বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ, পুঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহ’র দর্শন থেকে তিনি গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। যদিও দারিদ্র তাকে বাধ্য করে কৃষিকাজে তার শ্রম ব্যয় করতে। কিন্তু কোন কিছু তাকে গান থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তিনি আধ্যাত্মিক ও বাউল গানের দীক্ষা লাভ করেছেন কামাল উদ্দীন, সাধক রশীদ উদ্দীন, শাহ ইব্রাহীম মাস্তান বকশ এর কাছ থেকে। তিনি শরীয়ত, মারফত, নবুয়ত, বেলায়াসহ সবধরনের বাউল গান এবং গানের অন্যান্য শাখার চর্চা করেছেন।