পুঁজিবাজারে কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমানো যাচ্ছে না। নানা প্রক্রিয়ায় কোম্পানিগুলো দুর্নীতি করে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর দুর্নীতির অন্যতম সহায়ক মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো থেকে যাচ্ছে আড়ালে। তাই দুর্নীতি না কমে উল্টো বাড়ছে।
সাধারণত কোনো প্রতিষ্ঠানেকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে প্রথমেই যেতে হয় ইস্যু ম্যানেজার বা মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর কাছে। ইস্যু ম্যানেজারের মাধ্যমেই পুঁজিবাজার হতে অর্থ উত্তোলন করতে হয়। এ পর্যন্ত অনেক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে দুর্নীতির মাধ্যমে, আর্থিক বিবরণীতে ভুল তথ্য দিয়ে, লাভ বেশি দেখিয়ে পুঁজিবাজার থেকে প্রিয়ামসহ অর্থ উত্তোলন করেছে যা সর্বজনবিদিত।
কিন্তু প্রাথমিকভাবে কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পূর্বে যে ধরনের সক্ষমতা দেখিয়ে থাকে, পুঁজিবাজার হতে অর্থ উত্তোলন করার পরে প্রতিষ্ঠানের সে আর্থিক অবস্থা বজায় থাকছে না।
আবার কখনও কখনও প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য ইস্যু ম্যানেজারকে বিভিন্ন শর্ত দেয়। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোম্পানির আর্থিক বিবরণী কোম্পানির চাহিদামাফিক তৈরি করে থাকে। কখনো বা কোম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্য গোপন করে।
ফলে কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন দেখে বোঝার উপায় নেই বাস্তব চিত্র আসলে কি। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (এসইসি) যখন ইস্যু ম্যানেজারের মাধ্যমে কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হওয়ার আবেদন জানায় বা নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রিমিয়াম দাবি করে। সে ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিবেদন দেখে বোঝার কোনো উপায় থাকে না নিয়ন্ত্রক সংস্থার।
যেহেতু ইস্যু ম্যনেজার বা মার্চেন্ট ব্যাংককে এ কাজ করার জন্য এসইসি লাইসেন্স প্রদান করেছে। তাই মার্চেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে দেয়া তথ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশ্বাস করছে। ফলস্রুতিতে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে প্রতিষ্ঠানটিকে পুঁজিবাজার হতে অর্থ উত্তোলনের অনুমোদন দেয় এসইসি।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোম্পানি প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত আর্থিক তথ্য তুলে ধরতে চায় না। আর ইস্যু ম্যানেজারও প্রতিষ্ঠানটিকে সে আর্থিক পরিস্থিতি গোপন করতে সহায়তা করে। এর ফলে বাজারে ঢুকে পড়ছে আর্থিক ত্রুটিপূর্ণ তথ্যের কোম্পানি।
প্রাথমিকভাবে কোম্পানির মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও), শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভি), শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস), রিজার্ভ, লেনদেন ইত্যাদি দেখে বিনিয়োগকারীরা ভালো সম্ভবনা খুঁজে পান বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু প্রকৃত তথ্য অন্যরকম। ফলে বিনিয়োগকারীদের ভাগ্যে যা হওয়ার কথা তাই হচ্ছে। পরবর্তী অর্থবছরেই পূর্ববর্তী বছরের আর্থিক তথ্যের সঙ্গে ব্যপক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
কখনও কোম্পানির খারাপ আর্থিক চিত্র দেখে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে অর্থ তুলে নেন। ফলে ক্রমাগতভাবে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দর পড়ে যাচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে পরবর্তী বছরগুলোতে আর্থিক প্রতিবেদনে কোম্পানির নাজুক পারফরমেন্স ফুটে ওঠার কারণে স্টক এক্সচেঞ্জ কতৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটিকে জেড অথবা ওভার দ্যা কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেটে স্থানান্তর করে।
পরবর্তীতে সে শেয়ার বিনিয়োগাকরীর জন্য এক ধরনের বোঝায় পরিণত হয়। কারণ ওটিসি মার্কেটে থাকা কোম্পানিগুলোর কোনো ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায় না। উপরোক্ত বর্ণনার মাধ্যমে বোঝা সম্ভব শুধুমাত্র ইস্যু ম্যানেজারের অবহেলা কিংবা দূর্নীতির কারণে একটি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগাকরীদের কেমন ভোগান্তির শিকার হতে হয়।
কিন্তু, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি আর্থিক প্রতিবেদনে কোনে ধরনের ভুল তথ্য কিংবা অনিয়মের জন্য শুধুমাত্র কোম্পানি কতৃপক্ষকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়। ইস্যু ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করা মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো প্রাথমিক রেগুলেটরের দায়িত্বপালন করলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর অবহেলার জন্য কোনো ধরনের কারণ দর্শানো নোটিশ কিংবা জবাবদিহিতার আওতায় আনাছে না এসইসি।
সম্প্রতি পদ্মা ইসলামী লাইফ ইস্যুরেন্সের দুনীতির জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে কারণ দর্শানো নোটিশ প্রদান করা হয়। শুনানিতে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আর্থিক তথ্য গোপন করার কথা শিকার করা হয়। কিন্তু এ জন্য পদ্মা ইসলামী লাইফ ইস্যুরেন্সের ইস্যু ম্যানেজার ইউনিয়ন ক্যাপিটালকে কোনো প্রকার কারণ দর্শানো নোটিশ প্রদান করা হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছে যে কোনো কোম্পানির প্রসপেক্টাসে ভুল কিংবা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য না দেয়ার জন্য ওই কোম্পানির ইস্যু ম্যানেজার সমানভাবে দায়ী। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ভবিষ্যতেও এ ধরনের দুর্র্নীতি হতে থাকবে বলে মনে করছেন তারা।
মার্চেন্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারাই বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্চেন্ট ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই কোম্পানিগুলোর প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) প্রস্পেক্টাসে অসম্পূর্ণ আর্থিক তথ্য দেখিয়ে অতিরিক্তি প্রিমিয়াম নিচ্ছে। এতে পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যা দীর্ঘমেয়াদে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর অনেক অসাধু মার্চেন্ট ব্যাংক এ প্রক্রিয়ায় সহায়তা প্রদান করছে যা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না।