সাইবার ক্রাইমসহ আধুনিক মাধ্যম ব্যবহারে সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের অপরাধের তদন্তে সক্ষমতা বাড়াচ্ছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এজন্য সংশ্লিষ্ট কাজে পর্যাপ্ত জনবল বাড়ানোর সুপারিশও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। চলছে কারিগরি নানা দিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ।
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়েছে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেন্টারের (সিআইসি) কাজ। প্রকল্পটির কাজে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে তিন মিলিয়ন ইউস ডলার যা বাংলাদেশি প্রায় ২৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের ডিসেম্বরে এটির কাজ শেষ হবে। এ জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ১৫০ জন কর্মকর্তার চাহিদা পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে সিআইডি।
পুরান ঢাকার মিলব্যারাকে সিআইসির ভবনের কাজ চলছে। সেখানে সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ নেবেন পুলিশ কর্মকর্তারা। থাকবেন বেসরকারি পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞরাও।
বিদেশ থেকে ‘ডিজিটাল ইনভেস্টিগেশন’ সংক্রান্ত পাঁচ মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে পুলিশের ছয়জন কর্মকর্তা এখন সিআইডিতে কাজ করছেন। ২০১৪ সালের জুনে দক্ষিণ কোরিয়ায় যাওয়ায় এ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারী দলে আছেন দুইজন সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার (এএসপি), একজন প্রোগ্রামার ও তিনজন উপপরিদর্শক (এসআই)।
সিআইসিতে যা থাকছে
সিআইসি প্রকল্পের পরিচালক বিশেষ পুলিশ সুপার শেখ রেজাউল হায়দার নতুন বার্তা ডটকমকে জানিয়েছেন, সিআইডিতে সাইবার ক্রাইম নিয়ে যে ১০জনের টিম কাজ করছে, তাদের মধ্যে প্রশিক্ষিত ওই ছয়জনও আছেন।
তিনি বলেন, “বর্তমানে ‘সাইবার ক্রাইম স্কোয়াড’ ও ‘আইটি ক্রাইম’ নামের দুটি ইউনিটে সিআইডিতে ১০ জনের দলটি কাজ করছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সিআইসি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পর্যায়ক্রমে দেশের সব থানায় তদন্তকারী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এর দ্বারা সেসব কর্মকর্তা সাইবার অপরাধের অভিযোগ পেলে আলামত সংগ্রহসহ প্রাথমিক কাজগুলো করতে পারবেন।”
সিআইডির এই শীর্ষকর্তা বলেন, “সিআইসি প্রকল্পের ফলে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে যেসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, সেগুলোর তদন্তকাজ অনেক সহজ হবে। সনাক্ত করা যাবে মোবাইল ও ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন যন্ত্রের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধে জড়িতদের।”
সিআইসি প্রকল্পে দুটি বিভাগ থাকছে। ট্রেনিং ও অপারেশন। ট্রেনিং বিভাগে তদন্ত ও আইনি বিষয়ে প্রশিক্ষণ থাকবে। আর প্রশিক্ষিত কর্মকর্তারা তাদের দক্ষতা প্রমাণ করবেন অপারেশন বিভাগে বিভিন্ন মামলার তদন্তকাজে।
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসাদের একজন পুলিশের সিনিয়র এএসপি মুহাম্মদ জালাল উদ্দিন ফাহিম। তিনি নতুন বার্তা ডটকমকে বলেন, “আমাদের প্রশিক্ষণে ছিল মূলত কম্পিউটার এবং মোবাইলসহ ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের বিষয়।”
ফাহিম বলেন, “বর্তমানে সারা দেশ থেকে ফেসবুকসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে অসামাজিক প্রচারণা এবং আইডি হ্যাকিং ও ভুয়া আইডি সংক্রান্ত অভিযোগগুলো বেশি পাওয়া যাচ্ছে। তবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেহেতু মোবাইল ও অনলাইনে লেনদেনের সেবা বাড়াচ্ছে তাই আগামীতে সাইবার ক্রাইমের বড় অংশ হবে এসব ক্ষেত্রে। আমরাও এসবে গুরুত্ব দিচ্ছি।”
প্রয়োজন সচেতনতা
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা অ্যাট বার্মিংহাম-এর কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ড. রাগিব হাসান বলেন, “সাইবার ক্রাইম সম্পর্কে বাংলাদেশে একটা ভুল ধারণা আছে- প্রচলিত ধারণায় সাইবার ক্রাইমকে ফেসবুক/ই-মেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাক কিংবা ওয়েবসাইট হ্যাক করা হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু আসল ক্রিমিনালরা কি মোটিভেশন বা প্রেরণায় সাইবার ক্রাইমে যোগ দেবে? জবাব একটাই- টাকা!”
তিনি বলেন, “ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যাংকিং বা পেমেন্ট সিস্টেমে হামলা আসবে তা অবধারিত। আর কোনো পিস্তল-বন্দুক ব্যবহার না করে ঘরে বসে কোটি টাকা চুরির সুযোগ পেলে অপরাধীরা সেটা অবশ্যই করবে। নিজেদের মেধা না থাকলেও মেধাবী কিন্তু বিপথগামী কাউকে ব্যবহার করে করবে। বাংলাদেশে সাইবার ক্রাইমের এই নতুন ধারা সম্পর্কে সবাইকে সচেতন হতে হবে।”
এই বিশেষজ্ঞের মতে, অনলাইনে এর ওর বদনাম বা সম্মানহানি ঠেকানোর পেছনে সরকারের মূল সাইবার ক্রাইম আইনের মনোযোগ চলে গেছে। এই সুযোগে আস্তে আস্তে আর্থিক সাইবার ক্রাইম আস্তানা গাড়ছে বাংলাদেশে। সারাবিশ্বে আর্থিক সাইবার ক্রাইম একটা বড় সমস্যা অনেক দিন ধরেই, তা ঠেকানোর জন্য সর্বত্র প্রশিক্ষিত সাইবার ক্রাইম ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে।
সচেতনতা তৈরিতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন
সাইবার অপরাধীদের সনাক্ত ও আইনের আওতায় আনলেই এ ধরনের অপরাধ বন্ধ হবে না। বরং এর জন্য দরকার সচেতনতা। সাইবার অপরাধীদের হাত থেকে বাঁচতে সবচেয়ে বড় দিক হলো- আইডি, পাসওয়ার্ডসহ অ্যাকাউন্টের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যবহারকারী সচেতন হওয়া। তাহলে অপরাধীরা যতো বড় ফাঁদই তৈরি করুক তাতে পা ফেলবে না ব্যবহারকারী।
এজন্য তরুণ একদল যুবক কাজ করছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিয়ে। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস (সিসিএ) ফোরাম নামের এ সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকরা বেশিরভাগই কারিগরী নানা বিষয়ে দক্ষ। গত মে থেকে তারা কাজ করছেন। বর্তমানে অনলাইনে সাইবার ক্রাইম সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচারকাজ চলছে তাদের। কিছু দিন পর ঢাকাসহ সারা দেশে এ ধরনের ক্যাম্পেইন করা হবে।
সিসিএ ফোরাম জানিয়েছে, বর্তমানে সাইবার ক্রাইমে ভুক্তভোগিদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। অপরাধের ধরণ ও ভয়াবহতা সম্পর্কে জানলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অপরাধ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সহজ হবে। এজন্য একটি জরিপকাজ শুরু করেছে সংগঠনটি। সারা দেশে সাইবার ক্রাইমের ভুক্তভোগীদের মতামত নিয়ে এ জরিপ চলছে।এখানে ক্লিক করে জরিপে মতামত দিতে পারবেন।
সচেতনতা তৈরি ছাড়াও সাইবার ক্রাইমে ভুক্তভোগীদের সহায়তা দিচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী এ সংগঠন। তাদের ফেসবুক পেজ facebook.com/ccaforum ফেসবুক গ্রুপ: facebook.com/groups/CCAforum