হাঙ্গেরিতে বেশ ক’দিন আটকে থাকার পর হাজার হাজার অভিবাসী এখন অস্ট্রিয়া ও জার্মানির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অস্ট্রিয়ার সাথে সীমান্ত আর বুদাপেস্টের মূল রেল স্টেশন থেকে শ’ শ’ মানুষ রেলগাড়িতে উঠে বসছে। শুধু গতকালই অস্ট্রিয়ায় ঢুকেছেন অন্তত ১০ হাজার মানুষ। এসব অভিবাসী, যাদের সিংহভাগই সিরিয়া থেকে আসা, তাদের অনেকে ইতোমধ্যে জার্মানির মিউনিখেও পৌঁছে গেছে। চরম বিপদসংকুল দীর্ঘ এক যাত্রার পর ভিয়েনার রেল স্টেশনে এসব আশ্রয় প্রার্থীদের চোখে মুখে স্বস্তির চিহ্ন ফুটে উঠেছে। জার্মানির ট্রেনে ওঠার আগে ভিয়েনার রেল স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন আনাউদ। তিনি সিরিয়ার রাকা থেকে পালিয়ে এসেছেন। এ তরুণী বলেছেন, সবাই এখানে খুবই খুশি। এখন আর তারা ভয় পাচ্ছেন না। ভিয়েনাতে নারী, পুরুষ, শিশু সবাই তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। তারা তাদের খাবার দিচ্ছে, পানি দিচ্ছে, কফি দিচ্ছে, ব্যাগ দিচ্ছে।
এদিকে গত ৪৮ ঘণ্টায় ১০ হাজার আশ্রয় প্রার্থী হাঙ্গেরি থেকে অস্ট্রিয়ায় ঢুকেছে। অস্ট্রিয়ার সরকার বলছে, তাদের কাউকে আটকানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। ভিয়েনা থেকে জার্মানির মিউনিখে নেয়ার জন্য বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে অস্ট্রিয়ার কর্তৃৃপক্ষ। শনিবার প্রায় ৭ হাজার অভিবাসী মিউনিখে পৌঁছে। রবিবারভোরের দিকেও কয়েকশ’ শরণার্থী অস্ট্রিয়া থেকে ট্রেনে করে মিউনিখ স্টেশনে এসে নেমেছে। তাদের সেখানে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হচ্ছে এবং জার্মানির অন্যান্য শহরের ট্রেনে তুলে দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে কতো শরণার্থীকে জার্মানির আশ্রয় দেয়া উচিৎ তা নিয়ে সে দেশে বিতর্ক তীব্রতর হচ্ছে। চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মের্কেল বলছেন, সংখ্যা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন নন। কিন্তু জার্মানির দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকরা আপত্তি করছেন। তারা বলছেন, চ্যান্সেলর মের্কেল ভুল বার্তা দিচ্ছেন। পক্ষান্তরে অভিবাসীদের আটকে রেখে সেখানেই আশ্রয়ের জন্য আবেদন করার উদ্যোগ নিতে গিয়ে চাপে পড়া হাঙ্গেরি আপাতত তাদের সীমান্ত শিথিল করলেও তারা বলছে, সংসদ অনুমোদন করলে তারা সীমান্তে সৈন্য পাঠাবে।
অপরদিকে হাঙ্গেরি থেকে অস্ট্রিয়া ও জার্মানিতে আরো হাজার হাজার অভিবাসী ঢুকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অভিবাসীদের ভ্রমণের ওপর হাঙ্গেরি বিধিনিষেধ শিথিল করার পর ইউরোপের ওই দেশ দুটিতে শরণার্থীদের ঢল নেমেছে। হাঙ্গেরি থেকে অস্ট্রিয়া হয়ে গত শনিবার এক দিনেই জার্মানি পৌঁছায় ৪৫০ অভিবাসী। অভিবাসন-প্রত্যাশীরা ইউরোপে ঢোকার প্রধান পথ হিসেবে ব্যবহার করছে হাঙ্গেরিকে। সে হাঙ্গেরি থেকে সাড়ে ৬ হাজার অভিবাসী অস্ট্রিয়ায় পৌঁছায়। হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট থেকে অস্ট্রিয়ার পথেও আছে শত শত শরণার্থী। সাগর পাড়ি দিয়ে হাঙ্গেরিতে ঢুকতে থাকা অভিবাসন-প্রত্যাশীর ঢলও কমেনি।
অভিবাসীদের ব্যাপারে প্রথম কঠোর ছিল হাঙ্গেরি। দেশটি গত বৃহস্পতিবার কয়েক শ অভিবাসীকে ট্রেনে তুলে নিয়ে বুদাপেস্ট থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে একটি স্টেশনে নামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। সেখান থেকে অভিবাসীদের একটি আশ্রয়শিবিরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে হাঙ্গেরির পুলিশ। এভাবে কয়েক দিন চলার পর ওই অবস্থান থেকে সরে আসে দেশটি। হাঙ্গেরি সরকারের দেয়া প্রায় ৯০টি বাস, ট্রেন ও পায়ে হেঁটে অভিবাসীরা অস্ট্রিয়া সীমান্তে পৌঁছায়। এরপর সেখান থকে তারা ভিয়েনা ও মিউনিখের পথে যাত্রা করে।
অভিবাসীদের চাপ সামলাতে আরো ট্রেন প্রয়োজন বলে অস্ট্রিয়ার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। জার্মান চ্যান্সেলর অভিবাসী সংকট নিয়ে জোটের অংশীদারদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। আর অস্ট্রিয়ার কর্মকর্তারা জানান, কমপক্ষে ১০ হাজার অভিবাসী সীমান্তে এসে পৌঁছেছেন। তবে তাঁদের ঢোকার ব্যাপারে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করেনি অস্ট্রিয়া। অভিবাসীদের অনেকে মিউনিখ যেতে আগ্রহী। বিপন্ন এ মানুষগুলোকে সাদরে বরণ করেছে জার্মানিও। স্থানীয় বাসিন্দারা তাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছেন এবং বাচ্চাদের হাতে মিষ্টি তুলে দিচ্ছেন। এরপর তাদেরকে নাম নিবন্ধনের জন্য অভ্যর্থনা কেন্দ্রগুলোতে পাঠানো হচ্ছে। সেখানে তাদেরকে খাবার ও পোশাক দেয়া হচ্ছে। তুরস্কের অন্যতম অবকাশ যাপন কেন্দ্র বোদরামের সৈকতে ভেসে আসা ৩ বছর বয়সী সিরীয় শিশু আয়লান, তার ভাই গালিব ও মা রেহানার স্মরণে কানাডার ভ্যানকুভারে একটি স্মরণসভা করা হয়েছে।
অনেক স্বপ্ন নিয়ে ২ সন্তান আয়লান ও গালিব এবং স্ত্রীসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে সমুদ্রপথে ইউরোপের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন সিরিয়ার আব্দুল্লাহ কুর্দি। গ্রিসের কস দ্বীপ ছাড়ার একটু পরেই বড় একটি ঢেউ আছড়ে পড়ে তাদের বহনকারী নৌকাটির ওপর। এ সময় প্রাণপণে স্ত্রী ও সন্তানদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু পারেননি। মরিয়া হয়ে একসময় তিনি নিজেই নৌকাটি চালানোর চেষ্টা করেন। আর তখনই আছড়ে পড়ে আরেকটি ঢেউ। ততক্ষণে সব শেষ। নিজে কোনোমতে প্রাণে বাঁচলেও একে একে সাগরে ভেসে যায় তার স্ত্রী ও ২ ছেলে। ২ ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে আয়লানের নিথর দেহ গত বুধবার পাওয়া গেছে।
জার্মানি ও হাঙ্গেরি বলেছে, অভিবাসন প্রত্যাশীদের নিয়ে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়ায় সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়েছে। এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। এরপরে আশ্রয়ের জন্য তাদের আবেদন করতে হবে। মেরকেল বলেন, কোনো ধরনের কর বা শর্ত ছাড়াই জার্মানি অভিবাসীদের তাদের দেশে ঢুকতে দেবে। জার্মানিতে চলতি বছর ৮ লাখ অভিবাসী আশ্রয় নিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আফগানিস্তান ও ইরিত্রিয়ার পর সিরিয়ায় বর্বর গৃহযুদ্ধ ও জঙ্গিদের হাতে গণহত্যার কারণে মূলত বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের ঘর ছেড়ে ইউরোপ পালাচ্ছে।